সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষীপর্ব ২০
★
৪ বছর পর,
" আমি সুবর্ণা। কিংবা অন্য কেউ। একজন মাঝবয়েসী তরুণী। বয়সটা ঠিকঠাক লিখতে পারছি না কারণ আমার জন্মদিন এমনকি আমার জন্ম সালটাও আমার মনে নেই। আসলে আমি কে আমি কি করি কোথায় থাকি কিছুই আমার মনে নেই। একদিন হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি যেন এই পৃথিবীতে এই প্রথম চোখ খুললাম। এখানকার মানুষ, জায়গা কিছুই আমি চিনি না কিংবা হতে পারে সত্যিই চিনতে পারছি না। প্রায় পনেরো দিন হয়ে গেছে আমি কোমা থেকে বেরিয়েছি। আমাকে যারা দেখাশোনা করছেন তাদের ভাষ্যমতে গত তিন থেকে সাড়ে তিন বছর নাকি আমি কোমায় ছিলাম। একটা এক্সিডেন্টে আমার অবস্থা ভীষণ ক্রিটিকাল হয়ে যায়। সত্যি নাকি মিথ্যা আমি কিছুই জানি না। শুধু একজন মহিলা আছেন যাকে দেখলে আমার সত্যিই মা মা ফিলিং আসে। তার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় সত্যিই বুঝি ইনি আমার মা। মহিলার নাম কাশফিয়া রহমান। উনার কথামতো আমি নাকি উনার একমাত্র মেয়ে৷ আমি সত্যি মিথ্যা জানি না। তবে উনাকে মন থেকে আমার মা ভাবতে ইচ্ছে করে। উনার শরীর থেকে আমি কেমন যেন মা মা গন্ধ পাই।
গত পনেরো দিন ধরে ওই মানুষটা আমার জন্য পাগলের মতন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কখন কি খাবো কি পরবো, কি করবো, খারাপ লাগছে কি না, মাথা ব্যাথা হচ্ছে কি না সবকিছু নিয়েই তিনি ভীষণ অস্থির থাকেন। তবে ওনার মুখে সবসময় অদ্ভুত এক হাসি লেগেই থাকে। স্বস্তির হাসি। উনাকে দেখলে আমার মনে হয় যেন গত তিনটা বছর উনি এই দিনেরই অপেক্ষা করে গেছেন। কবে আমি চোখ খুলবো, কবে আমি তাকে মা বলে ডাকবো।
বাবাকে নিয়ে উনি আমাকে কিছুই বলেন না। জানতে চাইলে শুধু বলেন আমি এখনো ভীষণ অসুস্থ। আরেকটু সুস্থ হই, তারপর নাকি আমাকে সব আস্তেধীরে জানানো হবে। আমি শুধু এতটুকুই জানি আমার বাবার নাম শাহরিয়ার কবির। কোনো এক দুর্ঘটনায় তিনি মারা গেছেন।
আমি এখন কোন জায়গায় আছি তাও জানি না। শুনেছি আমার এবং আমার মায়ের নাকি লাইফ রিস্ক আছে। আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা কিছু মানুষ পাহারা দিয়ে রাখেন। ঠিক পাহারা না, আমার দেখাশোনা করেন। এর মধ্যে একজন হলেন আমার মা।
আমি এখন যেই বাসাটায় আছি সেই বাসাটা একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি। অদ্ভুত রকমের সুন্দর বাড়িটা। বিশাল বাড়ির সামনে বড়সড় একটা বাগান। সেখানে হরেক রকম গাছ আছে। বাড়িটা যেমন বড়, বাড়ির আসবাবপত্রগুলো তেমন। টিভি, ফ্রিজ আলমারি, বুকশেল্ফ, সোফা সব। এই বাসায় একটা বড় গ্রামোফোনও আছে। আগে কখনো গ্রামোফোন দেখেছি কি না জানি না। তবে এখন দেখে ভীষণ ভালো লাগছে। এই বাড়িতে একটা লাইব্রেরিও আছে। সেখানে তাকে তাকে ভর্তি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন লেখকের বই। পুরো বাড়িটাতেই আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। এই বাড়ি যিনি তৈরি করেছেন তিনি যে ভীষণ টাকাপয়সার মালিক ছিলেন এবং ভীষণ সৌখিন ছিলেন সেটা বাড়িতে ঢুকলেই বোঝা যায়।
এই বাড়িএ কাজের লোকগুলো খুব অমায়িক মানুষ। চুপচাপ নিজেদের কাজ করতে থাকে, কখনো কখনো আমি নিজেই গিয়ে কথা বলি৷ আমাকে দেখলেই তারা ব্যাস্ত হয়ে যায় কে কিভাবে আমার সেবা করবে সেটা নিয়ে। আমার ধারণা উপর মহল থেকে হয়ত ওদের উপর এমনটাই নির্দেশ দেওয়া আছে।