#13

39 5 0
                                    

সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষী

পর্ব ১৩

ইন্সপেক্টর রবি সংকর দাস। নিজের টেবিলে বেশ গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। তার টেবিলে নতুন একটা কেসের ফাইল এসেছে। কেসটা একটু গুরুত্বপূর্ণ মানুষের বলেই তার কাছে এসেছে। এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার মার্ডার কেস। তার ওয়াইফকেও নাকি খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিলো কিন্তু মহিলা এখনো লাইফ সাপোর্ট নিয়ে বেঁচে আছে। মহিলা যদি মারা যান তাহলে সিঙ্গেল মার্ডার কেস থেকে ঝট করেই ডাবল মার্ডার কেস হয়ে যাবে এই কেসটা। তখন এর উপর আরো জোর দেওয়া হবে।
ইন্সপেক্টর রবি সংকর দাস কেসের ফাইলটা বেশ কয়েকবার মনোযোগ দিয়ে দেখে কিছুক্ষণ নিজের জায়গায় ঝিম ধরে বসে রইলেন। তার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে একটু নড়ে চড়ে বসলেন।
" স্যার, উনাকে নিয়ে আসা হয়েছে।"
" পাঠাও"
সেন্ট্রি চলে যেতেই একজন মাঝবয়েসী মেয়ে তার রুমে ঢুকলো। রবি সংকর দাস ইশারায় তাকে বসতে দিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। মেয়েটা কোনো কথা না বলে চুপচাপ পানিটা খেয়ে গ্লাসটা রেখে দিলো।
এই অল্প সময়ের ভেতরেই রবি সংকর দাস মেয়েটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিলেন।
"মিসেস অর মিস?"
" জি?"
" মিস সুবর্ণা! আপনি কি বিবাহিত? "
" জি না।"
"কয় ভাইবোন আপনারা? "
" জি আমি একাই। আমার কোনো ভাইবোন নেই।"
" তাহলে বাবাকে খুন করতে গেলে কেনো? সম্পত্তি আজ হোক বা কাল তুমিই তো পেতে? চুপ করে আছো কেনো উত্তর দাও?"
রবি সংকর দাস টেবিলে হাত দিয়ে জোরে একটা আওয়াজ করে প্রশ্নটা করতেই সুবর্ণা চমকে উঠলো। সুবর্ণা ঝরঝর করে কেঁদে দিতেই ইন্সপেক্টর আরো একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালেন।
" বি-বিশ্বাস করুন আমি বাবাকে মারিনি। আর আমি কেনই বা বাবাকে মারতে যাবো বলুন। আমি আমার বাবাকে মারিনি। আমি সত্যি বলছি স্যার।"
" তোমার মায়ের অবস্থা তো ভালো নয়। যদি বেঁচে ফেরেন তো ভালো। আর যদি উনি মারা যান তাহলে কিন্তু কেসটা ডাবল মার্ডার কেস হয়ে যাবে। এটা বুঝতে পারছো তো?"
সুবর্ণা আরো একবার চমকে উঠলো। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে কান্নাভেজা চোখে তাকালো।
উচা লম্বা কেমন ছিপছিপে চেহারা। গায়ের রঙ কালো। এক দেখায় কেউ বুঝতেই পারবে না ইনি এত বড় ইন্সপেক্টর। মনে হবে এইমাত্র বুঝি কারো মার্ডার করে বেরিয়ে এলেন।
সুবর্ণা চোখের পানিটুকু মুছে গলাটা একটু শক্ত করলো।
" আপনি এসব উল্টোপাল্টা কথা কেনো বলছেন স্যার? আপনার কাজ খুনিকে খুঁজে বের করা। আমাকে খুনি সাজানো নয়।"
" আমার কি কাজ সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। তবে আমি যে তোমাকে আপনি থেকে হুট করে তুমি করে বলছে এই ব্যাপারটায় তোমার কোনো ভাবান্তর দেখছি মা যে?"
বেশ শান্ত স্বরে কথাটা বললেন ইন্সপেকশন। কথাটা কানে যেতেই সুবর্ণা খেয়াল করলো লোকটা সতিই শুরুতে তাকে আপনি বলে সম্বোধন করেছে। কিন্তু কখন তুমি করে বলা শুরু করেছে খেয়ালই করেনি সে। কিন্তু এমন একটা সিচুয়েশনে এমন প্রশ্নটাকে অবান্তর ভেবে কোনো উত্তর দিলো না সুবর্ণা।
" অবান্তর প্রশ্ন আমি করি না সুবর্ণা। জীবনের চলার পথে খুব বিচক্ষণ হতে হয়। "
সুবর্ণা এই কথায় আরো একবার চমকে গেলো কিন্তু বাইরে থেকে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করলো। এই মানুষটাকে বড্ড গোলমেলে ঠেকছে সুবর্ণার।
" এখন আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবো, ঠিকঠাক মনে করে সেগুলোর উত্তর দাও।
আচ্ছা যখন তোমার বাবার মার্ডার হয় তুমি কোথায় ছিলে?"
বারবার এই মার্ডার, খুন এই শব্দগুলো প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছে তার বাবা আর নেই। সুবর্ণা বিশ্বাস করতে চাইছে না কিন্তু তবুও এই কথাগুলোই কয়দিন ধরে তাকে শুনে যেতে হচ্ছে। সুবর্ণা দেখলো রবি সংকর দাস নামক লোকটি খালি গ্লাসে আবারও পানি ভরে তার সামনে এগিয়ে দিলো।
সুবর্ণা পানিটুকু খেয়ে বলতে শুরু করলো,
" আমি সেদিন আমার বান্ধবী রিম্পির বাড়িতে ছিলাম। আসলে সেদিন আমার বান্ধবী রিম্পির বিয়ে হচ্ছিলো। মা বাবাও সেখানেই ছিলো। কিন্তু সন্ধ্যায় মা এসে আমাকে বলে যে বাবার কোনো জরুরি কাজ আছে বাড়ি যেতে হবে। আমি যেতে চাইলেও রিম্পির বাবা মা বিয়ে বাড়ি থেকে আমাকে ছাড়তে চাইছিলো না। মা বাবাও জোর করেনি। আমাকে রেখে তারা চলে যায় বাসায়। এরপর রিম্পির বিদায় হয়। আমাকে অনেকবার যেতে বলেছিলো ওরা, কিন্তু আমি সাথে যাইনি। রিম্পিকে বিদায় দিয়ে বাসায় ফিরবো তখনই আমার পাশের ফ্ল্যাটের আংকেলের কল আসে যে আমাদের বাসা থেকে নাকি কি সব শব্দ শোনা যাচ্ছে। এরপর আমি দ্রুত বাড়ি যাই আর...."
" তোমার বাবা মা যখন বাড়িতে আসেন তখন ঠিক কটা বাজে?"
" সন্ধ্যা সাতটা কিংবা সাড়ে সাতটা হবে।"
" তোমার বান্ধবীর বিদায় কখন হয়?"
" রাত সাড়ে দশটা নাগাদ।"
" আর তোমার পাশের বাসার আংকেল তোমাকে কল করে কখন?"
" রাত এগারোটার দিকে। "
" অত রাতে তুমি একাই বাড়ি ফিরছিলে? নাকি তোমার সাথে কেউ ছিলো?"
সুবর্ণা এবার একটু নড়েচড়ে বসলো।
" জি না। আমি একা ছিলাম না। আমার বন্ধুরা ছিলো সাথে। আমরা রিম্পিদের বাসা থেকে বের হতেই আংকেলের কল আসে৷ আর তখন আমার বন্ধুরা আমাকে আর একা ছাড়েনি। আমার সঙ্গে বাড়ি পর্যন্ত যায়। আর এরপর বাকিটা ওরাই সামলেছিলো।"
" তোমরা যখন বিয়ে বাড়িতে ঢোকো এবং বাড়ি থেকে বের হও তখনকার কিছু ছবি আমার কাছে আছে। এই ছবিগুলোর ভেতরে শুরু এবং শেষের ছবিতে চারজন মানুষ কম বেশি। কেনো?"
ইন্সপেক্টর রবি সংকর দাস ছবিগুলো সুবর্ণার সামনে টেবিলে সাজিয়ে দিলেন। সুবর্ণা ছবিগুলোতে একবার চোখ বুলালো।
" রিম্পি এবং রিম্পির হাসবেন্ড পরের ছবিগুলোতে নেই। কারণ ওরা তো চলেই গেছে। আর ওদের সাথে আমাদের বন্ধু কমলও যায়। আসলে রিম্পির শ্বশুরবাড়ি রংপুর।বার কমলের দাদুবাড়িও রংপুর। তাই কমল আগে থেকেই ডিসাইড করে রেখেছিলো ওদের সাথে চলে যাবে। পরদিন আমরা রিম্পির শ্বশুর যাবো সাথে সাথে কমলের দাদুবাড়িতেও ঘুরতে যাবো।"
" বেশ বেশ। কিন্তু এই চতুর্থজন?"
এই প্রশ্নটা শুনে হঠাৎ সুবর্ণার খেয়াল হলো সেদিন ওর বাবা মা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রীতমও কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে যায়। বলেছিলো এক দেড় ঘন্টা পর চলে আসবে। কিন্তু এরপর দুদিন কেটে গেছে। ওর জীবনে এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে কিন্তু প্রীতম! একটা বারও তো প্রীতম ওর খোঁজ নিলো না।
বাবা মাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে প্রীতমের কথা মাথা থেকেই বেড়িয়ে গিয়েছিলো।
" মিস সুবর্ণা শাহরিয়ার। আমাদের কাছে খবর আছে, কিছুদিন আগে এই ছেলেটি এবং তার বাবা বেশ ভোর বেলায় আপনাদের বাসায় গিয়েছিলো এবং আপনার বাবাএ সাথে তাদের বেশ ঝামেলাও হয়েছিলো।
আমাদের কাছে এও খবর আছে এই ছেলেটির সাথে নাকি আপনার বিয়েও হবার কথা ছিলো। "
সুবর্ণা চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছে। সুবর্ণাকে নীরব দেখে এবার রবি সংকর দাস নিজের গলার স্বর বাড়িয়ে দিলেন,
" মিস সুবর্ণা শাহরিয়ার!  আমাদের কাছে এও খবর আছে এই ছেলেটার জন্য নাকি স্কুল লাইফ থেকে প্রায়ই আপনার এবং আপনার বাবা মায়ের মাঝে ঝগড়াঝাটি হয়?"
সুবর্ণা নিজের মাথাটা নিচু করে চোখের পানিটুকু আড়াল করতেই ইন্সপেক্টর ভীষণ রেগে গেলেন। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর ভীষণ জোরে থামা মেরে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলেন,
" একটা ছেলের জন্য নিজের বাবা মাকে খুন করতে গেলেন? আপনার লজ্জা করে না? "
শেষ কথাটা শুনতেই সুবর্ণা ধরমর করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
" আপনি ভুল করছেন স্যার। আ-আমি আমি খুন করিনি। আমি..."
রবি সংকর দাসের ইশারায় জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সেন্ট্রি একটা প্যাকেট এনে সুবর্ণার সামনে টেবিলে রেখে চলে গেলেন।
সুবর্ণা প্যাকেটটির দিকে তাকাতেই কেমন কেঁপে উঠলো।
" চিনতে পারছো? ঘড়িটাকে?"
গলার স্বর আবার স্বাভাবিকে এনে প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর।
সুবর্ণা প্যাকেট থাকা ঘড়িটা হাতে নিতেই দরদর করে ঘামতে শুরু করলো।
" এ-এটা? এ-এটা তো.... এটা আপনারা কো-কোথায় পেলেন? এটা তো প্রীতমের ঘড়ি। আ-আমি ওকে কিনে দ-দিয়েছিলাম। এটা..."
ইন্সপেক্টর সুবর্ণার হাত থেকে ঘড়িটা ঝট করে কেড়ে নিলেন।
" এটা হচ্ছে অপরাধীর ফেলে যাওয়া প্রুভ। এই ঘড়িটা আমরা স্পট থেকে পেয়েছি। দেখতে পাচ্ছেন ঘড়িটার গ্লাস ভাঙা? আর ঘড়িটায় কটা বাজে লক্ষ্য করেছেন?"
সুবর্ণা এবার কাঁদতে কাঁদতে ঘড়িটার দিকে তাকালো। সুবর্ণার মাথা কাজ করছে না। সে যা ভাবছে তা হতেই পারে না। সুবর্ণা লক্ষ্য করলো তার মাথাটা ভীষণ ব্যাথা করছে। পুরো পৃথিবীটা কেমন দুলে দুলে উঠছে।
" ঘড়িটা রাত আটটা দশে বন্ধ হয়ে গেছে। আর তুমি কি জানো তোমার বাবার মার্ডার কখন হয়েছে? রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটার ভেতরে।"
ইন্সপেক্টর রবি সংকর দাসের শেষ কথাটা শোনার সাথে সাথেই সুবর্ণা জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পরে গেলো।

(চলবে...)

সুবর্ণলতা [Completed✔️]Where stories live. Discover now