সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষীপর্ব ২৬
★
থাই গ্লাসের ভেতর দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদ ভেতরে ঢুকছে। এই আলোতেই প্রীতমের ঘুম ভাঙলো। প্রীতমের বিছানার সামনেই বিশাল থাই গ্লাসে আটকানো বারান্দা। প্রীতম চাইলেই এখানে একটা পর্দা লাগাতে পারে, কিন্তু ইচ্ছে করেই লাগায়নি। পর্দা লাগানো থাকলে নাকি ঘুম ভাঙা চোখে দিনের প্রথম সৌন্দর্যটা উপভোগ করা যেত না।
প্রীতমের ঘুম ভাঙলেও সে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করলো। আজ বাইরে যাওয়ার তাড়া নেই। দুদিন হয়েছে সে দেশ থেকে ফিরেছে। ছুটি এখনো একদিন আছে। এরপর কাজে গেলেই চলবে।
প্রীতম এখন নিজের ক্যারিয়ার বেশ ভালোমতো গুছিয়ে নিয়েছে। ছোটবেলার সেই আকিঁবুকিঁই এখন তার ক্যারিয়ারের বিশাল অংশ। প্রীতম প্রায়ই ভাবে, দেশে থাকলে এমন সুন্দর জীবন হয়ত তার কখনই হত না। বাবার কথায় চার বছর আগে যদি এই বিলেতে পারি না জমাতো, তাহলে হয়ত এখনো নিজের বন্ধুদের মতন সিজিপিএ নিয়ে ঘুরে বেরাতে হত। অবশ্য একদিক দিয়ে প্রীতম এটাও স্বীকার করে যে তার এই অল্প বয়সে এত সুন্দর ক্যারিয়ার গঠনের পেছনে একটা বিশাল অবদান তার বাবার টাকা এবং প্রভাব।
প্রীতম বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। এরপর এক মগ কফি বানিয়ে বারান্দায় এসে বসলো।
প্রীতমের বাড়িটা একটু নিরিবিলি জায়গায়। আশেপাশে সুন্দর গাছ গাছালি। পাশেই একটা পার্ক। যেখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করে, ছেলে মেয়েরা জগিং করে।
প্রীতম কফিতে প্রথম চুমুকটা দিয়েই কিছু বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করলো,
" আমি প্রীতম। তবে চার বছর আগের প্রীতম আর এখনকার প্রীতমের মাঝে ঘটে গেছে বিরাট পার্থক্য। চার বছর আগে এই আমি একটা মেয়ের জন্য নিজের জীবনটাও দিতে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু এখন এই আমি নিজের লাইফ নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক ব্যাস্ত এবং খুব খুশি ছিলাম। হ্যাঁ ছিলাম। কারণ ঠিক দুদিন আগে আমার জীবনে এমন অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছে যার পর থেকে আমি আর ভালো থাকতে পারছি না।
চার বছর আগে আমার যে মেয়েটির সাথে সম্পর্ক ছিলো সেই মেয়েটির উপর আমার ভীষণ রাগ অভিমান জমে ছিলো। শুধুমাত্র সেই মেয়েটির উপর রাগ আর ঘৃণা থেকে আজ আমি এই জায়গায় আছি। কিন্তু আজ যখন জানতে পারলাম আমার সেই রাগ এবং ঘৃণার পুরোটাই ভিত্তিহীন! তখন আমি এবং আমার সাজিয়ে তোলা পৃথিবীটা যেন সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
চার বছর আগে আমি যখন সুবর্ণাকে জানাই আমি আমেরিকায় আসছি, সুবর্ণা আমার কোনো কথাই বুঝতে চায়নি। ও চাচ্ছিলো আমি থেকে যাই কিন্তু সেটা তো সম্ভবই না। ও আমার স্কলারশিপের সাথে নিজের সামান্য চান্স পাওয়ার তুলনা করছিলো। এরপর আমি ওর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু ওর নাম্বার বন্ধ পেয়েছি এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও ওকে আমি খুঁজে পাইনি। পুরো ঘটনাটা বাবা শোনার পর বাবা আমাকে বলেছিলো হয়ত অভিমান করেছে সেজন্য এমন করেছে। এরপর আমি ওর সাথে যাবার আগে শেষবারের মত দেখা করতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম ও এয়ারপোর্টে আসুক, একটাবার আমাকে বিদায় জানাক। কিন্তু না। ও আসেনি। সুবর্ণা আমাকে কেমন অদ্ভুত ভাবে অপমান করেছিলো সেদিন। আর সেই অপমানের জ্বালাতেই আমি আজ এই জায়গায়। আমার মাঝে একটা জেদ ছিলো আমি ওকে দেখিয়ে দেবো ও কি হারিয়েছে। কিন্তু.....
কিন্তু চারটা বছর পর আমি যখন নিজের জীবনে অনেকটা এগিয়ে গেছি, নিজের জীবনটা সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নিয়েছি ঠিক সেই মুহূর্তে এসে আমি জানতে পারলাম গত চার চারটা বছর ধরে সুবর্ণার কিছু মনেই নেই। মেয়েটা আমাদের সব স্মৃতি এমনকি আমাকেও ভুলে গেছে। সত্যি বলতে আমেরিকায় আসার পরেও যখন সুবর্ণা আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি, তখন আমিও আমার জীবন থেকে ওর সব স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছি এবং আমি তা পেরেওছি। এই চার বছরে আমার একবারের জন্যেও ইচ্ছে হয়নি এটা জানতে যে ও কেমন আছে। কিন্তু দেশে আসার সময় যখন সুবর্ণাকে দেখলাম, আমি কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলাম।
বাড়ি ফিরেই আমি ওর সাথে থাকা সেই ছেলেটির সাথে যোগাযোগ করি। আর তখনই জানতে পারি সুবর্ণা সেদিন এয়ারপোর্টে ঠিকই এসেছিলো। কিন্তু মাঝপথে ওর এক্সিডেন্ট হয় এবং তিন বছরেরও বেশি সময় মেয়েটা কোমায় ছিলো। কোমা থেকে বের হলেও মেয়েটার আগের কোনো স্মৃতিই মনে নেই। আরো একবার আমি সম্পুর্ন ভুল বুঝে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম। অথচ এই ভুল বোঝার কোনো ভিত্তিই নেই। কারণ মেয়েটা তো কিছু করেইনি। "
প্রীতম লক্ষ্য করলো তার হাতে থাকা কফি মগটা খালি। সে বুঝতে পারলো অনেকক্ষণ আগেই হয়ত কফি শেষ হয়ে গেছে আর সে ভাবনায় এতটাই মগ্ন ছিলো যে খালি মগেই চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। নিজের মনেই একটু হেসে উঠলো প্রীতম। " দেখেতো সুবর্ণা। আজও তোমার কথা ভাবতে বসলে আমি বিভোর হয়ে শুধু তোমার কথাই ভাবি। আশেপাশের কিছুই আমার চোখে পরে না।"
প্রীতম নিজের কফি মগটা নিয়ে উঠে কিচেনের দিকে এগোলো। আর এককাপ কফি না খেলেই না। মাথাটা ধরেছে।
কিচেনের দিকে পা বাড়াতেই কলিং বেল বেজে উঠলো।
প্রীতম দরজা খুলে খানিকটা ভরকে গেলো।
" জিনিয়া তুমি এত সকালে?"
" ইয়াহ বেবি ইটস মি। কখন থেকে বেল বাজাচ্ছি। তুমি কি ঘুমুচ্ছিলে?"
কথাটা বলতে বলতেই জিনিয়া প্রীতমকে জড়িয়ে ধরলো।
" না না একটু আগেই উঠেছি। "
জিনিয়া ভেতরে ঢুকে প্রীতমের বেডে বসে পরলো।
" বেবি! তোমার হাতে কফি মগ কেনো? এখনো তুমি ব্রেকফাস্ট করোনি?"
" না জিনিয়া। "
" ওহ গ্রেইট। দাও মগটা দাও। আজকে আমি তোমার ব্রেকফাস্ট বানাবো আর দুজনে একসাথে ব্রেকফাস্ট করবো। ওকে বেবি? জাস্ট গিভ মি সাম টাইম।"
জিনিয়া প্রীতমের হাত থেকে কফি মগটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।
প্রীতম মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পরলো।