বিকেলে গাড়ি নিয়ে বেড়োলাম একটু। আজ শিক্ষক দিবস, তাই কিছু বন্ধুদের সাথে ডিনার প্ল্যান হয়েছে। বিকেলটা তাদের সাথে কাটাবো আর রাত্রে একসাথে ডিনার করে ঘরে ফিরব। এখন এই শিক্ষক দিবসের আমেজটা একটু অন্য রকম। যদি আরও কয়েক বছর পিছনে তাকাই, তখন দেখতে পাই বন্ধুরা সবাই মিলে একশ, দুশো টাকা দিয়ে সেই টাকায় টিচারের জন্য কেক, চকলেট, পেন আনতাম। আর মাত্র কয়েক বছরেই সব পালটে গেল। এখন আমার জন্য আমার ছাত্র ছাত্রীরা এই কাজ করে। হ্যাঁ আমি এখন একজন শিক্ষক। আমি এখন কলেজের প্রোফেশর। তাই সকাল বেলাটা আমারো বরাদ্দ থাকে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। আর এই কারনেই আমার বাকি সমস্ত শিক্ষক বন্ধুদের সাথেও প্ল্যানটা ডিনারেরই হল।গাড়ি যখন পার্কিং করলাম স্পটে তখন হঠাৎ খেয়াল পড়ল এক বয়স্ক ভদ্রলোকের দিকে, তিনি খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছেন বটে, তবে হাতে একটা প্লাস্টিক আছে যেটিকে খুব যত্নে নিয়ে যাচ্ছেন । বোঝায় যাচ্ছে খুব দামি কোনো জিনিস হবে। ভালো করে দেখতে গেলাম আর তখনই অন্যদিক থেকে বন্ধুরা হাত নাড়িয়ে ডাকল আমায় তাই ওনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম। গেলাম বন্ধুদের কাছে। এক বন্ধু বলল, "চল তাহলে, মুভির টিকেটটা কেটে নিই সবাই।"পা বাড়ানোর সাথে সাথে একটা বিকট আওয়াজে সবাই থমকে গেলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি সেই বয়স্ক ভদ্রলোক রাস্তায় পড়ে গেছেন, আর একটা বাইক এসে তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তখনো স্টার্ট বন্ধ না করাই বাইকটা গোঁ গোঁ শব্দ করছে। দু পাশের লোকজন ছুটে এসে প্রথমেই সেই বয়স্ক লোক টাকে তুললেন। আর অতঃপর বাইকের লোক টাকে কয়েকটা বাজে কথা শুনিয়ে দিয়ে বললেন, "দেখে চালাতে পারেন না? অন্ধ নাকি? একটা বয়স্ক মানুষ হেটে যাচ্ছে, দেখবেন না রাস্তাটা?"সে আর কোনো কথা তোয়াক্কা না করে বাইক নিয়ে সোজা বেড়িয়ে গেল। কান্ড দেখে আর তো দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। ছুটে গেলাম আমরা চার বন্ধু। দেখি তার হাতের কোনুই কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে, আর হাটুর কাছেও অনেকখানি কেটে গেছে। ওনাকে তুলে দোকানে বসানো হয়েছে। আর এতক্ষন পর ওনার মুখ দেখে আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। সেই চেনা মুখ, চেনা চোখ। আমি বললাম, "স্যার! আপনি!"তিনি আমার দিকে আবছা চোখে তাকিয়ে বললেন, "কে? ঠিক চিনলাম না তো।" আমি বললাম, "আপনি আমার সাথে চলুন গাড়িতে। বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। যেতে যেতেই নাহয় পরিচয় দেব।" তিনি অবাক হয়ে বললেন, "না না আমি যেতে পারব নিজেই, ধন্যবাদ।" আমার এক বন্ধু বলল, "না না আপনার যা অবস্থা, হাটতে গেলে কষ্ট হবে। ওর সাথে ওর গাড়িতেই যান আপনি।" এতক্ষনে দুজন এসে জল দিয়ে ওনার হাত আর পা এর কাটা গুলো ধুয়ে দিয়েছে। উনি হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বললেন, "কিন্তু আমি তো ঠিক..."আমি ওনাকে বললাম, "আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন। চলুন আমার সাথে। আমি চিনি আপনার বাড়ি।" বন্ধুদের বললাম, "তোরা যা ঘুরে আয়, পরে কোনোদিন আমিও যাবো তোদের সাথে।" বলে স্যারের হাত ধরে আস্তে আস্তে গাড়ির কাছে নিয়ে এসে গেট খুলে দিলাম। উনি বসলেন। আমি গাড়ি চালাতে চালাতে বললাম, "ঘড়ির মোড়, ইলেক্ট্রিক অফিসের দুটো বাড়ির পরে আপনার বাড়ি। তাই তো?" উনি বললেন, "হ্যা ঠিক বলেছেন। কিন্তু আপনার নাম টা।"আমি- "স্যার আমায় আপনি বলবেন না দয়া করে। আমি আপনার স্টুডেন্ট, আত্রেয়ান গোস্বামি। নাইন, টেন, ইলেভেন, টুয়েলভ আপনার কাছে বাংলা পড়েছি, সেই বাংলায় কাঁচা ছেলেটাকে আপনি বাংলা শিখিয়েছিলেন। আমি সেই আত্রেয়ান। আজ থেকে প্রায় আট বছর আগের কথা।"স্যার- "আত্রেয়ান!! কত বড়ো হয়ে গেছো তুমি! আর কত ভালো মানুষ হয়েছো! আমি খুব খুশি হলাম তোমার সাথে এতদিন পর দেখা করে। তা তুমি এখন কোথায় থাকো? কি করো?"আমি- "স্যার আমি এইচএস এর পর ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে কলেজে ভর্তি হই। তারপর অনার্স, মাষ্টার্স, পিএইচডি শেষ হয়েছে আগের বছর। আর এই বছর আমি নতুন চাকরি পেয়েছি। মহসীন কলেজের প্রোফেশর এখন। থাকি এখানেই। কিন্তু স্যার আমি তো আপনাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম, আপনি একসেপ্ট ও করেছেন। কিন্তু অনলাইন থাকেন না তো। থাকলে সব দেখতে পেতেন।"স্যার- "বাহ খুব খুশি হলাম। তুমি ভালো চাকরি পেয়েছো, সব চেয়ে বেশি ভালো লাগছে যে তুমিও একজন শিক্ষক এখন। আর ফেসবুক? ফেসবুক আমার ছেলে খুলে দিয়েছিল, তারপর আমি আর ঠিক করে ওসব করতে পারিনা, তাই বন্ধ হয়েই পড়ে আছে।"আমি- "বুঝলাম সব। কিন্তু স্যার আপনার পায়ে কিছু হয়েছে? আর স্কুটি চালান না?"স্যার- "সে এক কান্ড। স্কুটি থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে গেছিল আগের বছর, প্লেট বসানো আছে। তাই ডাক্টার বলেছে দু বছর পর স্কুটি চালাতে। আর সেই জন্যই হেটে হেটেই বেড়িয়েছিলাম আমার ছাত্রদের একটু খাওয়াব বলে। কিন্তু তারপরেই... এই রে, আমি যে ভুলেই গেলাম।"আমি- "কি হল স্যার?"স্যার- "আমার ছাত্রদের জন্য খাবারটা যে নেওয়াই হল না।"আমি- "ওই চলে এসেছি। ওখান থেকে নিয়ে নেবো চলুন।"স্যার- "তাই চল। আমার আজকের এই খারাপ দিনের মধ্যেও কি যে সুন্দর একটা সময় কাটল বলে বোঝাতে পারব না।"স্যার গাড়ি থেকে নেমে সামনের রেস্টোরেন্টে না গিয়ে একটা দোকানেই ঢুকলেন। অর্ডার করলেন দশটা এগ রোল। আমারো কেমন সেই আট বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল। স্যার আমাদেরও এগ রোল খাওয়াতেন। আর এই বছরের একটা দিনের অপেক্ষায় বসে থাকতাম আমরা সবাই। এত কিছুর পরিবর্তনের মাঝেও মানুষটা এক রকমই আছেন। সেই পোশাক, সেই কথা বলা, সেই চিন্তা ভাবনা... হঠাৎ আমার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললেন, "ওইসব রেষ্টোরেন্টে ক্যাশ টাকা নেয় না, তাই আমি দোকানেই কিনি। আর জানি তোমার এসব ভালো লাগবে না, তাও দিলাম। তুমিও তো আমার ছাত্র ছিলে।"সেই চেনা গন্ধটা পেলাম। বললাম, "আমি এখনো আপনার ছাত্র আছি স্যার। তবে আমি এই এগ রোল নেবো একটাই শর্তে। আমার সাথে আপনাকে রেষ্টোরেন্টে যেতে হবে।"স্যার একটু থতমত খেয়ে বললেন, "কিন্তু আমার ছাত্ররা যে বাড়িতে অপেক্ষা করছে!"আমি বললাম, "পাশের গলিতেই তো বাড়ি। চলুন এগুলো দিয়ে এসে আমি আজ আপনাকে নিয়ে রেষ্টোরেন্টে যাবো।" কিছু তেমন বলতে পারলেন না। দুজনে স্যারের বাড়ি থেকে ফিরে এসে ঢুকলাম রেষ্টোরেন্টে। অর্ডার দিলাম আমাদের খাবার। স্যার কাচুমাচু মুখ করে বললেন, "আমি তো অনলাইনে টাকা দিতে.... "আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, "আপনি যে বাংলায় কাঁচা ছেলেটাকে পড়িয়েছিলেন, এটা তার উপর থাক। প্লিজ না বলবেন না।"স্যার রাজি হলেন। আমি বললাম, "দিন আপনার ফোনটা, একটা ছবি তুলে দিই। তারপর আপনি সেটা ফেসবুকের প্রোফাইলে লাগাবেন। আমি শিখিয়ে দিচ্ছি সব।"স্যার খুব খুশি হয়ে বললেন, "হ্যা দাও তো, আমায় একটু ফেসবুক শিখিয়ে দাও, তাহলে সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারব।"সমস্তটা দেখিয়ে দেওয়ার পর দেখলাম স্যার ফেসবুকে নিজের ছবি পোষ্ট করে ক্যাপশনে লিখলেন, "আমার জীবনের সেরা শিক্ষক দিবস কাটালাম।"আমি ওনার ছবিতে কমেন্ট করলাম, "শুভ শিক্ষক দিবস স্যার।"আজ রাত্রে ঘরে ফিরে বুঝলাম সত্যিই খুব সুন্দর একটা দিন কাটালাম। সব খারাপের মধ্যেও যে কিছু ভালো হয়, এটা তারই প্রমান। বন্ধুদের সাথে সময় কাটালে যা আনন্দ পেতাম, আজ স্যারের সাথে সময় কাটিয়ে তার দশ হাজার গুন বেশি আনন্দ পেলাম আমি। সার্থক হল আজকের দিনটা।-শিল্পা প্রামানিক

YOU ARE READING
~HAWAII~
FantasíaStory about the island Hawaii...created with the favourite person, with love and Imagination.