সেই চেনা-অচেনা

2 2 0
                                    

"আসা হয় না আর সেরম, বহুযুগ আগে আসতাম" বলেই চুপ করে গেল আরাত্রিকা। ওর কথা শুনে প্রহেলিকা বলে "তাহলে হঠাৎ আজ?" "ইচ্ছে হল খুব, কত বছর পর দেখছি আবার সব, কিন্তু তেমন কিছুই বদলায়নি" বলেই শুরু হয় তাদের কথপকথন।

ট্রেন থেকে নেমে অটো ধরে আসার সময় পরিচয় হয় দুজনের। একই অটোতেই আসছিল দুজন, নামলো একই জায়গাতেই। কৌতুহলের সাথে প্রহেলিকা জিজ্ঞেস করে "আপনি কি ঘুরতে এসেছেন? না এখানেই বাড়ি আপনার?" উত্তরে তখন আরাত্রিকা সেই জবাব দেয় যে বহুযুগ আগে আসা যাওয়া ছিল তার। আরাত্রিকা তাকে জিজ্ঞেস করে, "আপনি এখানে?" সে উত্তরে বলে "ওই আপনার মতোই গল্প, হঠাৎ খুব ইচ্ছে হল একবার দেখতে, এক সময় ছিল যখন এই রাস্তা দিয়ে কতবার যাওয়া আসা করতাম সারাদিনে, এখন কেমন সব নিস্চুপ। আসাই হয় না আর। বিদেশ থেকে ফিরলে, একদিনের জন্য এসে দেখে যায়।" তারপর একটুখানি থেমে বলে, "আমরা একটু এগিয়ে জেতে পারি কি?" আরাত্রিকা বলে "হ্যা চলুন সামনে যায়, স্কুলের দিকটাই।"

দুজনে হাটতে থাকে রাস্তা ধরে। কথা হয়, কতদিন কত মানুষের সাথে পরিচয় হয় আমাদের, সবার আলাদা আলাদা গল্প নিয়ে জীবন। সবার জীবনের খুব গভীরে না গিয়েও, তাদের স্বতঃস্ফূর্ত এই ছোট্ট ছোট্ট মুহূর্তগুলোই মনে করয়ে দেয় আমাদের মায়াবী মন। সে যতই ব্যস্ত হোক, যতই অভিমানী হোক, নিজের টান আর মায়া কাটাতে পারেনা কেউই। ভিটেমাটি ছাড়াও যে কোনো জায়গার উপর এমন টান আসে, তা না দেখলে সত্যিই বোঝা দুস্কর্ম। বরং এ এমন এক জিনিস যা হয়তো মাতৃভূমির উপরেও আসে না এতোটা। জীবনের খুব আনন্দের বা খুব কঠিন সময়গুলোর ছিটেফোঁটা স্মৃতি যেন মনের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। গল্প করতে করতে দুজন আসে স্কুলের গেটের সামনে, এখন পুজোর ছুটি, তাই তাতে সেই পুরোনো মরচে ধরা তালাটা লাগানো, কত বছরের পুরোনো তা জানা নেই। আরাত্রিকা তালাটায় হাত রেখে বলে "কি আনন্দ হত যখন ছুটি পড়ত স্কুলে...." প্রহেলিকা বলে "তখন ভাবিনি যে একদিন এই মরচে পড়া তালাটাই দেখতে আসব।" আরাত্রিকা বলে "তা বটে, মানুষের জীবন যে কোন ছন্দে চলে...."

একটু থেমে গিয়ে বলে, "দেখুন এতখন ধরে গল্প করছি, নাম টাই জিজ্ঞেস করা হয়নি। কি নাম আপনার?" উত্তর আসে "আমি প্রহেলিকা বোস, ২০০২ সালে এই স্কুল থেকেই Higher Secondary দিয়ে Pass Out। এখন বাড়ি বলতে New York, ওখানেই থাকি নিজের বাড়িতে। বছরে একমাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসি, এই যেমন ভাবে পরিচয় হল আমাদের। তুই কেমন আছিস আরাত্রিকা? আরাত্রিকা রয়, Roll number 1" বলেই হাসতে শুরু করে প্রহেলিকা। আরাত্রিকার এক নিমেষের মধ্যে মনে পড়ে যায় স্কুলের সমস্ত কথা। ফার্স্ট বেঞ্চ নিয়ে ঝামেলা, ম্যামদের কাছে নালিশ, স্যারদের বকুনি, টিফিন টাইমে অন্য বন্ধুদের Brain Wash, সমস্তকিছু। আরাত্রিকা বলে, "তু-তুই, আমি তো চিনতেই পারিনি। কিভাবে চিনলি আমায়?" প্রহেলিকা জানায়, "সেই কবি কবি ভাব ভাই Unique জিনিস তোর, আমি আগেই বুঝেছিলাম, শুধু অপেক্ষা করছিলাম যে চিনতে পারিস কিনা আমায়। তা তো চিনলি না, সেসব বাদ দে। বল তুই এখন কোথায়? আরাত্রিকা বলে, " Melbourne এ থাকি, সেখানেই College এর professor। তোর মতো অবস্থা আমারও, বছরে একমাসের ছুটি তে আসি একবার। তাও সেখানে পুজোর ছুটি নেই, আছে শুধু Halloween এর। আমি আগেই leave নিয়ে চলে এলাম দেশে পুজো দেখব বলে। তারপর বল, মনে আছে কেমন লড়াই হত আমাদের? তুই roll number 2, আমি 1, এই নিয়ে বিশ্বযুদ্ধ লেগে যেত।" তারপর দুজনেই হেসে ফেলে.... প্রহেলিকা বলে, "ছোটো ছিলাম আমরা, তাইনা? আরাত্রিকা উত্তর দেয়, "খুবই"।

দুজনের গল্পের মধ্যে ফুটে ওঠে, এক সময় এই নাম্বার, পড়াশোনা কিছুই কোনো ব্যাপার না। সেই আবেগ, সেই পুরোনো কিছু স্মৃতি নিয়েই আমাদের পথ চলা। সবার জীবন সমান নয়, সবার জীবনের আলাদা আলাদা গল্প আর ছন্দ। কিন্তু কোথাও এসে যেন এই আন্তরিকতাটাই সত্য। এই মায়া টাই জীবন্ত। ছোটোবেলার পুরোনো ঝামেলা গুলো এর কাছে বড়ই ক্ষীন।

~HAWAII~Where stories live. Discover now