পার্থক্য

4 1 0
                                        

আজ সকালে উঠে ভাবলাম একটু বাইরে থেকেই জল খাবারটা খেয়ে আসি। নিজে আর রান্না করতে ভালো লাগছে না। আজকে আবহাওয়াটাও বেশ সুন্দর, একটু ঘুরেও আসা হবে। বেড়িয়ে পড়লাম তৈরী হয়েই।

হাটছি রাস্তা দিয়ে, এখন সময় সকাল ১০টা। তাই রাস্তার ধারে ধারে ছোটো ছোট ছেলে মেয়েরা সবাই ব্যাগ নিয়ে, স্কুল ড্রেস পড়ে স্কুলে যাচ্ছে হেটে হেটে। কেউ আবার সাইকেল নিয়ে যাচ্ছে। সকালে এই বাচ্চা গুলোকে দেখলেই মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়। কেমন গুটি গুটি পায়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে নিজের ছোটোবেলাটাও। এই দেখেছেন, কথা বলতে বলতে এসে পড়েছি দোকানে, খেয়ালই করিনি। দোকানটা অনেকদিনের পুরোনো। আমি যখন একদম নতুন এখানে চাকরি পেয়ে আসি, তখন থেকেই দেখছি এটাকে। আজ আমার বারো বছর হয়ে গেল এখানে আসা, দোকান টারও তাই। তবে এতোদিনের পুরোনো হলেও বদল হয়নি তার। সেই ধোঁয়ায় ভরা ছোট্ট উনুনটা এখনো একই আছে। আর দোকানের সেই দাদাটা, সেও তাই। আমি গিয়ে বসে বললাম, "দাদা দুটো কচুরি আর ছোলার ডাল দেবেন, আর একটা চা।" কিছুক্ষন পর দেখি একটা বাচ্চা ছেলে এসে আমার সামনে প্লেট নামিয়ে দিয়ে গেল। এই বাচ্চাটাকে আগে তো দেখিনি কখনো। আজকেই প্রথম দেখছি। জিজ্ঞেস করলাম, "দাদা, এই বাচ্চাটা..." দোকানী বলে, "হ্যা, ওকে এই নতুন কাজে ঢুকিয়েছি, দুদিন হল। এখানেই কাজ করে, খায়, রাত্রে বাড়ি যায়।" আমি একটু থতমত খেয়ে বললাম, "কিন্তু এর তো এখনো আঠেরো বছর ও বয়স হয়নি। দেখে দশ বারো বছর লাগছে। তুমি এই ছোটো বাচ্চাকে কাজে নিয়েছো?" দাদা বলে, "আমি নিই নি, ও নিজেই এসে বলছিল যদি কোনো কাজ পাওয়া যায়, তাই আরকি... " আমি বাচ্চাটাকে ডেকে বললাম, "তোমার নাম কী?" সে উত্তর দিল, "বিতান।" জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি এখানে কাজ করছ কেন?" সে বলল, "আমার বাড়িতে কেউ নেই, শুধু মা আর আমি। এতদিন মা সেলাই এর কাজ করে সংসার চালাতো, আর আমি একটা সরকারি স্কুলে পড়তাম। কিন্তু মা এর খুব শরীর খারাপ। ডাক্তার বলেছে অনেক টাকা লাগবে অপারেশন করতে, মা এর ক্যান্সার হয়েছে। তাই আমি এখানে কাজ করি।" আমি তাকে বললাম, "কিন্তু এখানে কাজ করে তোমার মা এর অপারেশন এর টাকা জোগাড় হবে না। সে তো অনেক খরচ।" ছেলেটি বলল, "যতটা হয় ততটাই চেষ্টা করছি, আমার যে মা ছাড়া কেউ নেই আর।" আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। ওকে বললাম, "কত টাকা লাগবে অপারেশন করতে?" উত্তরে বলল, "পাঁচ লাখ।" এতো টাকা এই মুহুর্তে জোগাড় করা আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। আর এ তো ছোটো বাচ্চা। জিজ্ঞেস করলাম, "কত টাকা শোধ হয়েছে? সে বলল, " জমি বিক্রি করে দু লাখ শোধ করেছি।" আমি তাকে বললাম, "শোনো, আমার কাছেও বেশি টাকা নেই, তবে দু লাখ আছে। তুমি কী একটা কাজ করতে পারবে?" সে বলল, "হ্যা"। আমি বললাম, " তোমার মা যেখানে ভর্তি আছেন, সেখানে চল, আমি কথা বলব।" জলখাবার ফেলেই তার সাথে গেলাম সেই হাস্পাতালে। কথা বললাম রেসেপশনে। তাদের ক্যাশ দু লাখ চায় নাহলে অপারেশন শুরু করবে না। আমি কার্ডে দু লাখ পে করে বললাম শুরু করতে। সব কিছু হয়ে গেলে, আমার বন্ধু দের এক এক করে ফোন করতে শুরু করলাম। তাদের কেউ ২০ হাজার, ৩০ হাজার, ২৫ হাজার করে দিয়ে এক লাখ সম্পুর্ণ করল। পরেরদিন আবার সকালে সেই দোকানে গিয়ে দেখলাম ছেলেটার মুখে বেশ হাসি ফুটেছে। ওর মা এর অপারেশন শেষ, মা সুস্থ আছে। আজ বিকেলে তাকে ঘরে নিয়ে আসবে। আমি বিতানকে বললাম, "বিকেলে এখানে থেকো, আমি আসব।"

ঠিক কথা মতো আমি বিকেলে বিতানকে সাথে নিয়ে গেলাম তার মা ক আনতে। তিনি আমার হাত দুটো ধরে বললেন, "আপনার উপকার কোনোদিন ভুলব না। কিন্তু এতো টাকার ঋন যে শোধ করব, সে ক্ষমতাই তো নেই আমাদের।" আমি বললাম, "কোনো টাকা লাগবে না। আপনি বাড়ি ফিরে চলুন সুস্থ হয়ে। সেলাই এর কাজটা চালিয়ে যান। বিতানের পড়াশোনার দায়িত্ব আজ থেকে আমি নিলাম।

আনন্দ অশ্রু দেখলাম দুজোনের চোখেই। তারা আমায় অনেক জোর করল তাদের সাথে বাড়ি যাওয়ার জন্য, কিন্তু এখন সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে। আমি আমার ফোন নাম্বার দিয়েই নিজের বাড়ি ফিরে এলাম।

কাল থেকে সমস্ত ঘটনাটা ভাবছি। সত্যিই মানুষের জীবনে কত কষ্ট। যে সকাল বেলা দেখলাম ছেলে মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, সেই সকাল বেলা এক বাচ্চা দোকানে থালা বাটি ধুচ্ছে। কত পার্থক্য মানুষের জীবনের।

সাত দিন পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ এক আননোন নাম্বারে ফোন এল। হ্যালো বলতেই ওপার থেকে চেনা স্বরটা বলে উঠলো "আমি বিতানের মা বলছি। এখন আপনি একটু দেখা করতে পারবেন?" এক ঝটকায় লাফিয়ে উঠে বসে পড়লাম, "হ্যা বলুন, কোথায় আপনারা?" উত্তর এল, "সেই দোকানে।" তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। দোকানে গিয়ে দেখি বিতান একটা পেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই সে বলল, "আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছি আবার, এই তার কাগজ। আর মা সেলাই এর কাজ শুরু করেছে। তাই তোমার জন্য মিষ্টি এনেছি।"

আমার হাতে ধরিয়ে দিল একটা প্যাকেট।

সেদিন সন্ধ্যেটা হয়ত ছিল আমার জীবনের সেরা সন্ধ্যে। ওই সৎ পরিশ্রমের টাকায় আমার জন্য তারা মিষ্টি দিল। শুধু একটুর জন্য কানে এল শেষ কথাটা, "আমাদের তো আপনার ঋন শোধ করার মতো ক্ষমতা নেই, তাই এটুকু করলাম। আপনি না বলবেন না দয়া করে।"

~HAWAII~Where stories live. Discover now