তানপুরার মেজরাব

1 1 0
                                    

আরাত্রিকার মনে হয় তার মা সিড়ি থেকে অদ্ভুত এক আওয়াজ পেয়ে তাকে বলল সেখানে যেতে। তাদের ১৪৫ বছরের পুরোনো বাড়িটি ঘিরে রয়েছে অনেক স্মৃতি, অনেক ইতিহাস। তেমন এই সিড়িটি জুড়েও রয়েছে অনেক রহস্য। আরাত্রিকা সিড়ির কাছে গিয়ে জোরে "মা" বলে চিৎকার করে উঠল। যে দৃশ্য তার চোখের সামনে ফুটে উঠল, তা দেখে আরাত্রিকার বুক কেঁপে ওঠে। তার বাবা সিড়ির মুখে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। কাঁচা রক্ত বেয়ে পড়ছে নীচে। সেই রক্ত গড়িয়ে আসছে সামনের তানপুরার চেয়ারের দিকে। আর ৯৫ বছরের পুরোনো তানপুরাটা রাখা আছে চেয়ারের উপর, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে।

আরাত্রিকার চিৎকার শুনে মা তাড়াতাড়ি এসে বলেন "কি হয়েছে আরি?"সে আঙুল দিয়ে দেখায় তার মৃত বাবার শরীর। কিন্তু মা এর প্রতিক্রিয়া অন্যরকম হয়, তার মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শূন্য সিড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন "আর কতদিন আরি! কবে তুই ঠিক হবি!" সে তার মাকে বোঝায় কিভাবে বাবা সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে এইমাত্র এই অবস্থা ঘটিয়েছে। কিন্তু ১৪ বছর আগের ঘটনার প্রতিফলন একজন সুস্থ মানুষ ১৪ বছর আগেই ফেলে এসেছে। আরাত্রিকার মতো এর পুনরাবৃত্তি ঘটে না মায়ের চোখের সামনে।

একদিন তানপুরা বাজাতে বাজাতে আরাত্রিকা ভাবছিল এই বাড়ির ইতিহাসের কথা, কত পুরোনো রহস্য যেন ফিসফিস করে কথা বলে এর আনাচে কানাচে, আর তার সাথে ভয়ংকর লাগে সেই বহুদিনের চেনা পুরোনো চিলের ডাক। পিছনের পুকুর থেকে স্যাতস্যাতে পানা বাড়ির দিকে যেন তাকিয়ে থাকে। আর সাথে আসে একটা অদ্ভুত গন্ধ, এ যেন এই বাড়িরই ইতিহাসের গল্প। পুরোনো সেই গন্ধে বুঁদ হয়ে সেদিন তানপুরার শব্দে আর চিলের ডাকের মিশ্রনে অস্থির হয়ে সে হাত থেকে তানপুরার মেজরাবটা ফেলে দেয় ভুলবসত। জানলার নীচের পুকুরে গিয়ে পড়ে ৯৫ বছরের পুরোনো তানপুরার মেজরাব। সেই এক মুহূর্ত ছিল যখন আরাত্রিকার স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা লোপ পায় আর সে স্বাভাবিক মানুষ থেকে পরিনত হয় মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত আত্মায়। তানপুরাটা হাতে নিয়েই সে অজ্ঞান হয়ে যায় জানলায় মাথা রেখে। এই দৃশ্যকে গোচর করার মতো ক্ষমতা ছিল না তার, তানপুরাটা ছিল বড়ই প্রিয়। আর মেজরাব, যে সাহায্য করতো তাকে তানপুরায় টান দিতে, সেই আর নেই। আরাত্রিকা অজ্ঞান হয়ে যায়। মা বাবা তাকে সুস্থ করার পর আর তানপুরা বাজাতে মানা করেছিল। কিন্তু আরাত্রিকার খুব প্রিয় এই তানপুরাটা, সে কারও কথা তোয়াক্কা না করে মাঝরাত্রে সবাই ঘুমিয়ে গেলে বসতো সেটা নিয়ে। মন দিয়ে প্রান দিয়ে বাজাতো সেটা, অন্ধকার ঘরে, একা একা। একদিন রাত্রে তার বাবা উঠে এসেছিল এই ঘরে, ঘনীভূত অন্ধকার যেন তানপুরার তারের টানে হয়ে উঠেছিল আরো ভয়ানক। বাবা দেখতে পায় আরি পাগলের মতো তানপুরার তার গুলোয় টান দিচ্ছে আঙুলে করে আর বাষ্পীভূত স্বরে বলছে "মেজরাব চায়, আমার মেজরাব, আমার তানপুরার মেজরাব"। বাবা তার উত্তরে বলেছিল "শান্ত হও আরি, ওটা আর পাওয়া যাবেনা কখনো। আমি তোমায় তানপুরা বাজাতে মানা করেছিলাম তাই।" আরির ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে সিড়ি দিয়ে নামতে হয়নি তাঁকে আর। মাথায় আরির তানপুরার আঘাতে তার পুরো শরীর নিথর হয়ে গড়িয়ে এসেছিল সেদিন সিড়ি দিয়ে। সিড়ির পাশে চেয়ারটায় তানপুরা রেখে আরি মৃত বাবার আঙুল থেকে নখ উপড়ে নিয়ে রাখে তানপুরার তারের মাঝে আর বাজাতে থাকে ওটা একই সুরে। তার বাবা সিড়ির মুখে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। কাঁচা রক্ত বেয়ে পড়ছে নীচে। সেই রক্ত গড়িয়ে আসছে সামনের তানপুরার চেয়ারের দিকে। আর ৯৫ বছরের পুরোনো তানপুরাটা রাখা আছে চেয়ারের উপর, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে।

আওয়াজ পেয়ে তার মা আরিকে বলেছিলেন সিড়ির কাছে গিয়ে দেখতে। কিন্তু সে মেতে উঠেছিল তার বাবার নখ দিয়ে তানপুরা বাজানোয়। সে তার মাকে বোঝায় কি করে বাবা সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে এইমাত্র এই অবস্থা ঘটিয়েছে। মা বুঝেছিল আরির অসুস্থতা।

এই ১৪ বছর আগের ঘটনার প্রতিফলন পায় সে আজও। আরাত্রিকার মনে হয় তার মা সিড়ি থেকে অদ্ভুত এক আওয়াজ পেয়ে তাকে বলল সেখানে যেতে, আজ ১৪ বছর পরেও। সে যায়, আর তার মা কে বোঝায় কি করে বাবা সিড়ি থেকে পড়ে এইমাত্র এই অবস্থা ঘটিয়েছে।

~HAWAII~Where stories live. Discover now