চিতংবুড়া (২য় পর্ব)

6 0 0
                                    

আবারও নীতু একা হয়ে গেল। সাং এর কথাগুলো মাথার ভেতরে ঘোরাফেরা করল কিছু সময়। আসলে এই পরিবেশটাই বুঝি এমন ! যদি এই কথাগুলো সে নিজের অফিসের বসে শুনতো তাহলে পুরো ব্যাপারটা একেবারেই তার কাছে অন্য রকম মনে হত কিন্তু এই নির্জন পাহাড়ি পরিবেশে কথাগুলো মনের ভেতরে একটা অস্বস্তির অনুভূতি জাগিয়ে তুলছে। নীতু জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল । এই পাহাড়ি এলাকাতে মানুষের মনে নানান রকম কুসংস্কার থাকাটা স্বাভাবিক। ঋদ্ধ রায়হানকে নিয়ে পুরো দেশের মানুষের ভেতরেই নানান রকম মিথ চালু হয়ে আছে সেখানে এই পাহাড়িদের ভেতরেও যে মিথ থাকবে সেটাই সেটাই স্বাভাবিক।

আজকে সারাদিনটা নীতু কিভাবে কাটাবে সেটাই চিন্তা করতে লাগল । রান্না ঘরে গিয়ে এককাপ কফি বানালো নিজের জন্য। চুলাটা ক্যারোসিনের । তবে একটা মাটির চুলাও রয়েছে পাশে। এখানে সম্ভবত দুপুরের ভারী রান্না হয়। তবে চা কফির জন্য এই কেরোরিনের স্টোভটাই ব্যবহার করা হয় । কফির কাপটা হাতে নিয়ে সে সামনের বারান্দায় এসে হাজির হল। তারপর মন দিয়ে চারিদিকের আওয়াজ শুনতে চেষ্টা করল । সাং সত্যিই বলেছিল । এখানে আসলেই কোন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন পরিবেশ একেবারে শান্ত । এতো নির্জনতা নীতু এর আগে কোনদিন অনুভব করে নি। হঠাৎ করে নীতুর মনে হল বাইরের পৃথিবীর সব কিছু ছেড়ে এখানে চলে আসতে পারলে আর বাকি জীবনটা এখানেই পার করে দিতে পারলে মন্দ হত না। হয়তো লেখক ঋদ্ধ রায়হানও ঠিক এই মনভাব নিয়ে এই নির্জন পাহাড়ে পড়ে আছে । অবশ্য প্রথম প্রথম সবারই ভাল লাগবে। কিন্তু কয়েকদিন পার হতেই এখানে সে টিকতে পারবে না।
ঋদ্ধ রায়হানের ঘরে বেশ কিছু বই পাওয়া গেল। নিজের লেখা বই ছাড়াও অন্যান্য লেখকদের বইও রয়েছে। বইগুলোর ভেতরে কয়েকটা আবার এই বছরের বই মেলাতে প্রকাশিত। এছাড়া এই মাসের সদ্য প্রকাশিত কয়েকটা ম্যাগাজিনও রয়েছে। এগুলো নিশ্চিত ভাবে তার সম্পাদকরা তার কাছে সরবারহ করে থাকে। তার মানে দাড়াল যে বাইরের জগত থেকে একেবারে সে আলাদা নয়। বাইরর বিশ্বের খবরাখবর তার কাছে ঠিকই আসছে।

সকালের সময়টা নীতুর কেটে গেল বই পড়েই। দুপুরের কিছু আগে সে রান্না বসাল । সকালের মত করেই খিচুড়ি চাপিয়ে দিল। তারপরই নীতুর কাছে মনে হল সে পেছনের ঝর্ণা থেকে গোসলটা সেরে আসা যাক। খিচুড়ি হতে বেশ কিছু সময় লাগবে। এই সময়টা কিছুই করার নেই।
নীতু ঝর্ণার সামনে গিয়ে দাড়াল । ঠিক ঝর্ণা বললে ভুল হবে। ছোট পানির উৎস বলবেই ভাল । বেশ কিছুটা স্থান জুড়ে পানি জমে আছে । নিচের দিকের একটা অংশ খোদায় করা । স্পষ্টই এটা গোসল করার জন্য আলাদা ভাবে খোদাই করা হয়েছে। নীতু পানিতে যখন নামতে যাবে তখনই একটা খেয়াল মাথায় এল ওর। পুরো এলাকাতে কেউ নেই এখন । কাপড়ে পরে পানিতে নেমে সেটা ভেজানোর কোন মানে নেই। এমনিতে কাল আসার সময়ে ওর পরনের পোশাকটা ভিজে গেছে। আবার আরেকটা পোশাক পরে গোসলের কোন মানে নেই। এখানে ভেজা পোশাক কখন শুকোবে তার কোন ঠিক নেই।
নির্জন ঝর্ণার পাশে নীতু ধীরে নিজের শরীরের সব পোশাক খুলে ফেলল । তারপরই ঝর্ণার ঠান্ডা পানিতে শরীর ডুবিয়ে দিল । অদ্ভুত একটা অনুভূতি এসে জড় হল নীতুর মনে। এভাবে এমন খোলা জায়গাতে একেবারে বিবস্ত্র হয়ে গোসল করার সাহসটা ওর ভেতরে কিভাবে এল ! এমনটা যে আগে কোন দিন করেছে বলে মনে হয় না । তাহলে এখন কেন এমন কিছু করতে ইচ্ছে ওর?
তবে চোখ বন্ধ করে ঠান্ডা পানিতে পুরো শরীর ডুবিয়ে রাখতে অদ্ভুত একটা শান্তি লাগছে নীতুর। নীতুর বাসায় কোন বাথটাব নেই। কয়েকবার গিয়েছে কক্সবাজার। সেই কক্সবাজারের যে হোটেলগুলোতে ছিল তাদের ভেতরে দুইবার বাথটাবওয়ালা বাথরুম ছিল। সেখানে শরীর ডুবিয়ে বসে গোসল করেছিল। আজকেও সেই একই ভাবে আরাম করে ঝর্ণার পানিতে বসে রইলো।
কত সময় সে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল সেটা বলতে পারবে না তবে হঠাৎ ওর মনে হল যে কেউ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েদের এ অনুভূতিটা প্রায়ই হয়। যখন কেউ তাদের দিকে তাকায় তখন মেয়েটা বুঝতে পারে। নীতুরও ঠিক সেই রকম অনুভূতি হল । সাথে সাথে সে চোখ খুলে ফেলল। চারিদিকটা একেবার তাকিয়ে দেখল । কাউকে দেখতে পেল না। দেখতে পাবে না এটাই স্বাভাবিক । এই এলাকায় দুর-দুরান্তে কারো থাকার কথা না। এক হতে পারে ঋদ্ধ রায়হান ফিরে এসেছে । কিন্তু তিনি তো সামনের দিকে দিয়ে ফিরবেন। ঝর্ণার এই দিকে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। চারিদিকেই উপর পাহাড় আর বন জঙ্গল । এখান দিয়ে কারো আসার কথা না।
গোসল শেষ করে একই ভাবে সে বাসায় ফিরে এল ঘরে। খিচুড়ি ততক্ষণে হয়ে এসেছে । একেবারে রাতের খাবারও তৈরি হয়ে গেছে। রাতে আর রান্না না করলেও চলবে।

অতি-প্রাকৃত গল্পWhere stories live. Discover now