নির্বাণ আর সোনালির চাকরির দু-বছর অতিক্রান্ত। সময়ের সাথে তাল রেখে দু'জনেই ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে নিজেদের আরও প্রতিষ্ঠিত করবার তাগিদে, যদিও নির্বাণের তাড়া অনেক বেশী। নির্বাণ গত বছর প্রচুর টাকা বোনাস পেয়েছে। কোম্পানির টার্নওভার বেড়েছে, কাজেই মুনাফাও বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু সেই অজুহাতে আত্মতুষ্টির নামে আলস্য যাতে কাউকে গ্রাস না করতে পারে, তাই প্রথম সারির বসেরা টাকার ঝুলি নিয়ে জুনিয়ার ম্যানেজারদের আগাম প্রতিশ্রুতি আদায়ে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে বিনোদনের সুবন্দোবস্ত, এবং বড়ো কর্তাদের পিঠ চাপড়ানো তো আছেই। যতক্ষণ ঘোড়া ছুটছে ততক্ষণ সব ভাল, কিন্তু ঘোড়ার যে বিশ্রাম প্রয়োজন তা কারও মাথায় আসে না। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক, কারণ দু-চোখেই ঠুলি পরা। গাড়ি, বাড়ি, ক্লাব মেম্বারশিপ, আর বিদেশ ভ্রমণের সহজ সুযোগ খুঁজতে খুঁজতে মন সাফল্যের চোরাবালিতে কখন ডুবে যায় তা খেয়াল করা যায় না।
নির্বাণ চাকরি শুরু করেছিল মার্কেটিঙে, কিন্তু এখন পুরাদস্তুর টেকনিকাল অ্যানালিস্ট। শেয়ার মার্কেটের চার্টে চোখ রেখেই বেশী সময় কাটে। মজার কথা হল--চোখ বন্ধ করলেও চার্টের রেখাগুলো লতানে গাছের মতো চারপাশ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে, কিছুতেই ছাড়তে চায় না। কিছুদিন আগেই রিজিওনাল ম্যানেজার নির্বাণের কাজের খুব প্রশংসা করেছেন, সাথে সাথে দায়িত্বও বাড়িয়ে দিয়েছেন। মাঝে মাঝেই ভারতবর্ষের নানা শহর ঘুরে নির্বাণকে লেকচার দিতে যেতে হয়। বিভিন্ন কোম্পানির ভবিষ্যতের ছবি কি হতে পারে, কার বাজারদর কমতে পারে, আর কার বাড়তে পারে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হয়। কোম্পানির তরফ থেকে শেয়ারমার্কেটের তত্ত্ব ও তথ্য সরবরাহের আংশিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নির্বাণের ঘাড়ে। বিনা দ্বিধায় বলা যায় কোম্পানিতে নির্বাণের সম্মান দিনে দিনে বাড়ছে, কিন্তু তার সাথে সময়ের অভাববোধও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। বাজার আর বাড়ির টানাটানিতে নির্বাণ টানটান।
সোনালিও মাঝখানে বেশ কিছু মাস কাটিয়ে এসেছে হায়দ্রাবাদে, তাদের কর্পোরেট অফিসে বিশেষ ট্রেনিঙের জন্য। কাজ চলছে পুরো দমে, তার সাথে আড্ডাও। সোনালির বন্ধুবান্ধবের বৃত্ত ক্রমশই বাড়ছে, মিষ্টি ব্যবহারে আকৃষ্ট সবাই। ম্যানেজমেন্ট সোনালিকে অনেক ভেবেচিন্তেই পাবলিক রিলেশনের মতো গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন। কিছু কিছু ক্লায়েন্টের সাথে সোনালির ভীষণ ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সোনালির পছন্দের তালিকায় সবার প্রথমে আছেন সুজাতা সরকার--নিজের এন.জি.ও. সংস্থা আছে, বয়স ষাটের কাছাকাছি, কিন্তু মনের বয়স বাড়তে দেননি। সবসময় তরতাজা এবং সব বিষয়ে উৎসাহ সোনালির তাঁর প্রতি আকর্ষণের বিশেষ কারণ। সুজাতাদেবীর জীবন সম্বন্ধে ধারণা ভীষণ স্পষ্ট--পরার্থে বাঁচতে চান, মানুষের কাজে আসতে চান। নিজে জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই দেখেছেন বলেই হয়তো অজ্ঞানতা দূর হয়েছে, এবং দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়েছে। পরপর কয়েকটা রবিবার সোনালি তাঁর সাথে গ্রামে ওয়ার্কশপে গিয়ে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলে ভীষণ ভাল লেগেছে। অনেকদিন ধরেই সোনালির ইচ্ছা ছিল--এই ধরনের সেবামূলক কাজের সাথে যুক্ত থাকার, কিন্তু কিছুতেই সময় সুযোগ হয়ে উঠছিল না। সুজাতাদেবী সোনালির সেই সুপ্ত ইচ্ছায় ইন্ধন জুগিয়ে ছাই-চাপা আগুনের তেজ নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে তুলেছেন।
![](https://img.wattpad.com/cover/157510615-288-k332721.jpg)