বাজ পড়ার প্রচণ্ড শব্দে নির্বাণের সম্বিত ফিরে এল। আকাশ জুড়ে কালো মেঘ স্তূপীকৃত হওয়ায় মনে হল, জোর বৃষ্টি নামবে। এরকম কত বৃষ্টির দিন সৃষ্টিকর্তার নিয়ম মেনে তাদের দায়িত্ব পালন করে, আবার প্রকৃতির বিশাল ভাণ্ডারে হারিয়ে গিয়েছে, নির্বাণের কাছে তার খবর নেই। ইচ্ছা থাকলেও তার মন তাতে সাড়া দিতে পারেনি। কমোডিটি মার্কেটের চার্টের খামখেয়ালীপনার ওপর নজরদারী করতে করতে সময় বলের মতো গড়িয়ে গিয়েছে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটানা দৃষ্টি স্থির রেখে, দায়িত্বশীল পাহারাদারের ভূমিকা পালনের ফাঁকে, তাকে ফাঁকি দিয়ে নীরবে কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটা বছর।
মার্কেট নির্বাণকে কিছু দেয়নি তা নয়, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে তার অনেকগুণ বেশী। বাজারের চড়াই-উতরাইয়ে মশগুল নির্বাণ খেয়ালই করতে পারেনি কখন আপনার মানুষগুলো সম্পর্কের শক্তপোক্ত বাঁধন আলগা করে নিকট থেকে দূরে, এবং দূর থেকে আরও দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। নিজেদের ভালোবাসার বাড়ি যত্নের অভাবে অচেনা হয়ে গিয়েছে। জীবনে যাকে সবচেয়ে দামী সম্পদ বলে মনে করত, অমনোযোগিতার কারণে সে-ই আজ পাশে নেই।
ছাদের পর ছাদ তুললেই কি আর বাড়ি হয়? ইচ্ছা খুশী মতো দেওয়াল দিয়ে ফ্লোর ভাগ করলেই কি আর ঘর হয়? আত্মা উধাও--পড়ে আছে ইট, কাঠ, পাথরের জঞ্জাল।
নির্বাণ ছাড়া বাড়িতে দ্বিতীয় মানুষ নেই। কোথাও কারও নিঃশ্বাস পড়ছে না। সকালবেলাতেই চারপাশ নিস্তব্ধ, নিষ্প্রাণ। মনে হল--ঘরে বায়ু চলাচল পর্যন্ত নিষিদ্ধ। সব দ্বার রুদ্ধ। তাকে যেন বন্দী বানিয়ে রাখা হয়েছে তারই বাড়িতে। নির্বাণ বসবার ঘরে সোফায় বসে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, কি দেখছে নিজে জানে না। এক চুমুক জল গলায় ঢালতে বুঝতে পারল, জিবে কোন স্বাদ নেই। অনেকদিন জ্বরে ভুগলে, বা অ্যান্টিবায়োটিক খাবার ফলে যে অবস্থা হয় অনেকটা সেরকম।
নির্বাণের চোখে পড়ল একটা মোমবাতি স্ট্যান্ড যাতে অনেক বাতি একসাথে জ্বালিয়ে রাখা যায়। সোনালির খুব প্রিয় ছিল, নিউমার্কেট থেকে কিনেছিল। কত সন্ধ্যায় অন্য কোন আলো না জ্বালিয়ে, মোমবাতির মিঠে আলোয় গল্প করে রাত কাটিয়েছে। সব ছিল সোনালির পরিকল্পনা। তার ছোঁয়া এই ফ্ল্যাটের ইঞ্চিতে-ইঞ্চিতে, প্রত্যেক অণু-পরমাণুতে। নিজের হাতে সাজানো সংসার কি করে ছেড়ে যেতে পারল সোনালি?