সোনালি ছেলেবেলা থেকেই খুব আত্মবিশ্বাসী। সহজে বিচলিত হবার মেয়ে সে নয়, কিন্তু সেই মুহূর্তে ভীষণ অসহায় লাগল। আয়নায় চোখ পড়তেই নিজেকে সরিয়ে নিলো। পরক্ষণেই মনে হল—কিসের থেকে নিজেকে আড়াল করতে চাইছে? কাকে ভয় পাচ্ছে? বিদ্যা, বুদ্ধি, যুক্তি দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণে সে অপারগ। এত রাতে মা-কে ফোন করে বিরক্ত করতে চায় না, কিন্তু বাকী রাত কিভাবে কাটবে তারও হদিশ করতে পারছে না। নির্বাণের অচৈতন্য শরীরটা বেওয়ারিশ লাশের মতো পড়ে থাকতে দেখে মুহূর্তের জন্য সোনালির খারাপ লাগলেও সাথে সাথে মনে হল--এই পরিণতি ইচ্ছাকৃত, স্বেচ্ছায়।
ইদানীং, মিসেস সরকারের সাথে বহু প্রজেক্টে যুক্ত থাকায় গ্রামে-গঞ্জে বহু গরীব মানুষের সাথে মিলিত হয়েছে সোনালি। অভাব কাকে বলে? খেতে না পাওয়ার যন্ত্রণা কি? অবহেলা-অবসাদ কত গভীরে বাসা বাঁধতে পারে? তথাকথিত সামাজিক ভদ্রতার মুখোশ কত নির্লজ্জ হতে পারে, তার চাক্ষুষ প্রমাণ সে পেয়েছে।
সোনালি অন্তর্দর্শন শুরু করল। রেল লাইনের ধারে বস্তিতে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাদের বাঁচতে হয় তাদের জীবনের শুরুতে কোন মূলধন থাকে না। কারও সাহচর্য ছাড়াই আগাছার মতো সবার অলক্ষ্যে পলে পলে বেড়ে ওঠে, তাই হয়তো নিজের জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যায়, কিন্তু তার জীবনের এই হাল হবার কারণ কি? সোনালি নিজেকে প্রশ্ন করল। তার তো অগাধ মূলধন ছিল। গাড়ি, বাড়ি, অর্থ, ভালোবাসা, সামাজিক স্বীকৃতি, ভবিষ্যতের স্বপ্ন, নিজের চাকরি সব, সব ছিল। এতকিছু সহায় সম্বল হাতের নাগালে থাকা সত্ত্বেও সে কেন লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেল? বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তার পায়ের তলার মাটি আলগা হতে শুরু করেছিল, আর এই মুহূর্তে কোনও অঘোষিত অনিবার্য বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষারত।
ব্যর্থতার কাঁটা সোনালিকে বিঁধছে। টপটপ করে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। একটাই সান্ত্বনা, কেউ দেখার নেই। তাকে সান্ত্বনা দেবার মানুষ আজ থেকেও নেই। সোনালি উঠে চোখে মুখে জল দিয়ে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করল, কিছুটা সফলও হল। শোবার ঘর ছাড়া, অন্য ঘরের আলোগুলো নিভিয়ে শুতে যাবে, এমন সময় নির্বাণ ঘুমের ঘোরে চেঁচিয়ে উঠল, "সেল, সেল।" আবার নিস্তেজ।