শুরু হল আর এক অধ্যায়, এবার সান্যালসাহেবের জাগরণের পালা। ঘরের এক পাশে নিচের দিকে ফুট ল্যাম্পের আবছা আলো ঘরটাকে আজ আরও অন্ধকার করে দিয়েছে। একেবারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার একরকম, কিন্তু এক কোনায় এক চিলতে সলতের নিভু-নিভু আলো বড়ো ভয়ঙ্কর। বিপদ সময় সুযোগ বুঝে লক্ষ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে ধাক্কা দিয়ে তার কার্য চরিতার্থ করে একসময় ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে কিন্তু বিপদের আশংকা, পরিণতি প্রাপ্তির আশায় লোকচক্ষুর অন্তরালে জেগে থাকে এবং অন্যকে জাগিয়ে রাখে।
বালিশে মাথা রেখে আনমনে তাকিয়ে আছেন সিলিঙের দিকে অপূর্ব সান্যাল। ঘুমের কোন চিহ্ন নেই। তাঁকে কেন্দ্র করে বৃত্তের আকারে ঘুরে যাচ্ছে ভালবাসার মালায় এক সূত্রে গাঁথা মুখগুলো, সোনালি-নির্বাণ-সুনিপা, নূতন সংযোজন বহুদিনের পুরনো বন্ধু শৈবাল। ডাক্তার বন্ধুর রক্ত হিম করা আশংকা যদি শেষমেশ সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তবে কি বলে সান্ত্বনা দেবেন মেয়েকে? জোর গলায় বলতে পারবেন কি, এটাই জীবন, মেনে নিতে শেখ। স্বপ্ন আর বাস্তবের ফাঁকে যে ফারাক আবহমানকাল থেকে বিরাজমান তার জটিল তত্ত্ব সহজ সরল ভাষায় মেয়েকে বোঝাতে পারবেন কি? পৃথিবীতে কোন বাবা নিজের মেয়েকে এই চরম শিক্ষা কি কখনো দিতে চায়? ফুলের মত মেয়েটা চোখের সামনে শুকিয়ে যাবে আর তিনি নীরব দর্শক হয়ে তার সাক্ষী থাকবেন?
সান্যালসাহেবের মনে হচ্ছে হঠাৎ একদল মুখোশধারী গুণ্ডা এসে তাঁর পাসপোর্ট, ক্রেডিট কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স একে একে সব কেড়ে নিচ্ছে আর তিনি বিবশ হয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ।
সোনালিও নিজের বিছানায় চুপচাপ জেগে আছে, বিছানায় একটা লাশের মত। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। একদম একা, সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা দ্বীপে এসে পড়েছে। এ দেশের চাল-চলন, ভাষা কিছুই জানা নেই, নূতন করে শিখতে হবে। নার্সারি থেকে শুরু করতে হবে। ফোনটা বিছানার এক পাশে পড়েছিল, হাতে নিয়ে নির্বাণের ছবিটা স্ক্রিনে আনল। অন্ধকারে সোমালির হাতে নির্বাণ আলো হয়ে জলতে থাকল কিন্তু সেই আলোয় সোনালি আলোকিত হতে পারছে না বরং ক্রমশই তলিয়ে যাচ্ছে চিন্তার চোরা স্রোতে। নির্বাণের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সোনালি খেয়াল করেনি কখন পর্দায় ভেসে উঠেছে নির্বাণের মা, অনিমাদেবীর মুখ, মানুষের মুখে যে এত রেখা থাকে তা আজ প্রথম উপলব্ধি করল সোনালি, মনে হচ্ছিল কেউ তাঁর মুখটা চারপাশ থেকে জোর করে চেপে ছোট করে দিয়েছে, শোকের অভিব্যক্তি নিজে চোখে প্রত্যক্ষ করে এসেছে সোনালি। মনে হচ্ছে, 'নিয়তি মৃত্যু নিয়ে ছিনিমিনি খেলে একজনের সাথে কিন্তু তার ধাক্কায় দোদুল্যমান গোটা পরিবার। হসপিটালের শয্যায় মৃতপ্রায় একজন কিন্তু আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কায় ভীত, ত্রস্ত পরিচিত সবাই। মৃত্যু কি? সে সম্বন্ধে সম্যক ধারণা বা উপলব্ধি বোধহয় কারুরই নেই কিন্তু মৃত্যুভয় সবার চেনা। মৃত্যু জীবনে একবারই আসে কিন্তু মৃত্যুর হাতছানি অহরহ আমাদের ছায়া-সঙ্গী।'