ক্লাস রুমের ভেতরে পা দিতেই অনির কেমন যেন মনে হল । ওর পাশে দাড়িয়ে থাকা মুমু ওর হাত ধরলো আবার । মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, চল ভেতরে । সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে ।
অনির পুরো ক্লাস রুমের দিকে তাকিয়ে রইলো । কত পরিচিত এই ক্লাসরুম । আজকে প্রায় আট মাস পরে এখানে পা রাখছে । ভেবেছিলো হয়তো আর পা রাখা হবে না । তারপরও আজকে সে মোটামুটি সুস্থ হয়েই ফেরৎ এসেছে আবার। ক্যান্সারের ভয়াল থাবা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরে আনন্দ হচ্ছে । বেঁচে থাকাটা যে কত চমৎকার সেটা বুঝতে পারছে খুব ভাল ভাবে ।
ক্লাস রুমে ঢুকতেই বুঝতে পারলো সবাই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে । অবাক হওয়ার কারণটা সে নিজেও জানে । কেমো নেওয়ার আগে ওর মাথার চুল ফেলে দিতে হয়েছে সব । একটা মেয়ে মাথায় চুল নেই এটা দেখতে খানিকটা অস্বাভাবিকই লাগে । অনির মাথাটা স্কার্ফ দিয়ে ঢাকা । তারপরেও সেটা দেখতে একটু অস্বাভাবিক লাগছে । তবে সেটা সবাই কাটিয়ে উঠলো মুহুর্তেই । একে একে ওর কাছে এল । ওর খোজ খবর নিতে শুরু করলো । অনেকে নানা রকম গিফট দিলো ওকে । তখনই অনির চোখ গেল নয়নের দিকে । সবাই ওর কাছে এলেও নয়ন আসে নি । আসবে না অনি সেটা জানে । ক্লাসের কয়েকটা ছেলের সাথে অনির বনিবনা নেই একদম । তাদের ভেতরে নয়ন অন্য রকম । বিশেষ করে পড়ালেখার লড়াই টা তো রয়েছে । কে কাকে টেক্কা দিবে, কে কার ভুল ধরবে সেটা নিয়ে ওদের ভেতরে লেগেই থাকতো । নয়ন অনেক সময় ওর দিকে তাকিয়ে ছিল । তারপর ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে গেল ।
অনির মনটা একটু খারাপ হল বটে । এতোদিন পরে ওর ক্লাসে এল । একেবারে তো মরেই গিয়েছিলো । মৃত্যুর মুখ থেকে কোন মতে ফেরৎ এসেছে । এখনও কি সে আগের ঝগড়া মনে রাখতেই হবে ! কী হত এসে একটু কথা বললে !
কিন্তু অনির জন্য সম্ভবত অন্য কিছু অপেক্ষা করছিলো । ক্লাস শুরুর আগ দিয়ে নয়ন ক্লাস রুমে ঢুকলো । সাথে সাথেই যেন পুরো ক্লাস একেবারে চুপ হয়ে গেল । অনির চোখ যখন নয়নের দিকে পড়লো অনির বুকের ভেতরে একটা আশ্চর্য অনুভূতি হল । তারপর ও অনুভব করলো যে ওর চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এসেছে । আনন্দের অশ্রু !
নয়নের তার মাথার চুল ফেলে দিয়ে একেবারে টাক করে এসেছে । এই জন্যই সে বাইরে গিয়েছিলো । ক্যাম্পাসের সামনে সেলুন থেকে চুল ফেলে দিয়েছে । নয়ন এই কাজটা কেন করলো সেটা অনির বুঝতে মোটেও কষ্ট হল না । পুরো ক্লাসে কেবল অনির মাথায় চুল নেই । ওকে সঙ্গ দিতেই নয়ন এমন কাজটা করলো ।
নয়ন আস্তে আস্তে নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়লো । এমন একটা ভাব করলো যেন কিছুই হয় নি । এটাই খুব স্বাভাবিক ।
অনি এবার উঠে এগিয়ে গেল নয়নের দিকে । ওর সামনে গিয়ে বলল, তোমার পাশে বসবো?
নয়ন ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কেন আমার পাশে কেন? শত্রুর পাশে বসতে নেই জানো না?
অনি হেসে ফেলল । তারপর বলল, দুই চুল ছাড়া মানুষ এক সাথে বসলে ব্যাপারটা দেখতে দারুন হবে ! বুঝছো?
তারপর আর কথা না বলে অনি বসেই পড়লো । অনির কেন জানি ভাল লাগছে বেশ । এতোদিন পরে ক্যাম্পাসে এসে পরিচিত মানুষদের কে কাছে পেয়ে ভাল লাগছে । যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে ছিল তখন কত কথা মনে করেছে । বারবার মনে করেছে এবার ফিরে গিয়ে সবার সাথে আরও ভাল ব্যবহার করবে । সবাইকে বন্ধু বানাবে । কারো সাথে কোন প্রকার ঝামেলা করবে না । বিশেষ করে নয়নের সাথে আর কোন ঝামেলা করবে না । মিলমিশ করে ফেলবে । কিন্তু নয়ন যে এমন একটা কাজ করবে সেটা অনি মোটেও বুঝতে পারে নি ।
পরদিন অনি যখন আবার ক্লাসে অনির মনটা যেন আরও একটু বেশি আনন্দিত হয়ে গেল । ওকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য ওদের ক্লাসের আরও সাতটা ছেলে মাথার চুপ ফেলে দিলো । তারপর সবাই এক সাথে ছবি তুলে সেটা ফেসবুকে পোস্ট করলো । অনির মনে হল যেন ওর শরীর আরও একটু বেশি ভাল হয়ে গেছে । এতো খুশি খুশি লাগতে শুরু করলো যে ও কিছুতেই সেই অনুভূতি ভাষার প্রকাশ করতে পারবে না ।
-o-
এই ছোট গল্পটার উৎস একটা বাস্তব গল্প থেকে । ক্লাসমেট কেমোর জন্য মাথার চুল ফেলে দেওয়ায় তার ক্লাসের প্রায় ৪০ জন একই ভাবে চুল ফেলে দিয়ে ফেসবুকে ছবি আপলোড করেছিলো কেবল বন্ধুকে সাহস যোগাতে । তাকে সাহস দিতে যে আমরা আছি তোমার পাশে ! জীবনের এই ছোট ছোট গল্প গুলো কত চমৎকার !
YOU ARE READING
পরমানু গল্প গুচ্ছ
Short Storyমাঝে মাঝে জীবনের গল্প বলতে হাজার শব্দ লাগে না। মাত্র অল্প কয়েকটা লাইন দিয়েই বলা হয়ে যায় পুরো গল্প। পরমানু অনু গল্প গল্প গুলো এমনই। ছোট গল্পের জগতে আপনাকে স্বাগতম ।