তামিল নাড়ুর দ্বিতীয় দিন। ভেলরে গিয়ে সমস্ত ফর্মালিটিস শেষ করে একটা গাড়ি বুক করে যাওয়া হলো পুদুচেরিতে। প্রায় তিন ঘণ্টার রাস্তায় আমাদের দাঁড়াতে হল তিনবার; প্রথমবার চা-কফির জন্য, দ্বিতীয়বার প্রপার ব্রেকফাস্ট, এবং শেষবার লাঞ্চ এর জন্য। আমাদের গাড়িওয়ালা ছিলেন একজন স্থানীয় বাসিন্দা, নাম মহম্মদ ইব্রাহিম। পুরো রাস্তায় আমরা দুই একটা তামিল ভাষার শব্দ শিখতে না পারলেও তিনি কিন্তু আমাদের বাংলার তিন চারখানা বাক্য ঠিকই শিখে ফেলেছিলেন। অন্তর্মুখী হওয়ার ফলে আমি সেরকম কারোর সাথেই খুব একটা কথা বলিনা, বা বলতে পারিনা, অবশ্য বন্ধু বান্ধব হলে অন্য ব্যাপার। তাই আমাদের গাড়িওয়ালার সাথেও আমার তেমন কোনো বাক্যালাপ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ হলে হয়ত আমাকেও কাবুলিওয়ালা গল্পের ছোট্ট মেয়ে বানিয়ে ফেলতেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত আমার বয়স কুড়ি। তাই কাবুলিওয়ালার জায়গায় এই গল্পকে নিয়ে যাবনা।
আমাদের সমস্ত জায়গায় ঘোরার সময় এই গাড়িওয়ালার সাথে আমার এক অদ্ভুত রকমের অদৃশ্য কথপোকথন চলত। কখনও কফির সাথে কেক খাওয়ার সময় হাতে ধরিয়ে দিতেন টিস্যু, কখনও খেতে বসার সময় কলাপাতায় তুলে দিতেন দু-চামচ বেশি সাম্বার, কখনও আবার নন ভেজ আইটেম খাওয়ার সময় খুঁজে দিতেন হিন্দু রেস্তোরাঁ। এইসমস্ত কিছুর পরেও আমার সাথে ওনার তেমন কোনো কথা হয়নি ঘাড় নড়ানো ছাড়া। সম্ভবত দরকার পড়েনি, কারণ আমার অদৃশ্য ভাষা উনি বুঝে ফেলতেন। তৃতীয়দিন যখন আমাদের মন্দির যাওয়ার কথা হলো সেদিনও তিনি বললেন, মন্দিরে যেতে হলে তো নিরামিষ খাবার খেতে হয়, আমরা কি সারাদিন নিরামিষ খাবার খেয়ে থাকতে পারব? আমি কি নিরামিষ খেয়ে সারাদিন থাকতে পারব? অ্যাডাল্ট হওয়ায় একজন মানুষের সমস্তরকম অভ্যাস থাকা বাধ্যতামূলক বলে আমি মনে করি, তাই আমার শুধুমাত্র এই নিরামিষ খাওয়ার অপারকতায় ওনার কোনরকম ভাবনা চিন্তা করার কারণ ছিল না, তাছাড়া অন্য ধর্মের মানুষ হওয়ায় এত খুঁটিনাটি ওনার মনে থাকার কথাও নয়। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম যে ওনার চোখে আমি কুড়ি বছর বয়সী অ্যাডাল্ট নই, বরং কাবুলিওয়ালার ছোট্ট মেয়ে। নিজের এথেইস্ট হওয়ার চক্করে এসব আমিষ নিরামিষ এ বিশ্বাস করিনা আমি, আমি মানি মন শুদ্ধ ও পবিত্র থাকাটাই আসল, তার জন্য নিরামিষ খেয়ে মন্দিরে যেতে হয়না। কিন্তু সেই মন্দিরে যাওয়ার আগে আমাদের গাড়িওয়ালা ঠিকই খোঁজ রাখছিলেন যে "আমি" নিরামিষ খাবার খেয়ে সারাদিন থাকতে পারব কিনা।
মাঝের সমস্ত দিন এইভাবে ঘুরতে ঘুরতেই গেল। আসা হলো চেন্নাই এর কোভালামে আমাদের এই গাড়িওয়ালা সাথেই। উনি আমাদের জন্য বাঙালি রেস্তোরাঁ খুঁজে দিলেন এবং খুঁজে দিলেন সাগরপার ছোঁয়ানো হোম-স্টে, কারণ সকালে সমুদ্রের শব্দে ঘুম থেকে উঠতে এবং রাত্রে ঘুমোতে "আমার" খুব ভালো লাগবে। শেষ হলো সমস্ত কাজ এবং ফর্মালিটি। গাড়িওয়ালার চলে যাওয়ায় সময় এই শেষ এবং প্রথমবারের মতো আমার সাথে ওনার কথা হল। স্বভাববসত চুপ করে দাঁড়িয়ে আমি জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখছিলাম, উনি এসে স্মিত হেসে বললেন "ঠিক হ্যায় বেটা, বাই", আমিও উত্তরে বললাম "বাই"। উনি হেসে বেরিয়ে গেলেন আবার ভেলরের পথে। আমি তাকিয়ে রইলাম কোভালামের সমুদ্রের দিকে। ঢেউগুলো যেন আরো দ্বিগুণ গতিতে আছড়ে পড়ছে বালির উপর। নিচে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের গাড়িওয়ালা গাড়িতে চেপে চলে গেলেন উল্টোদিকের রাস্তায়।
আমি জানি, উনিও জানেন, এই শেষবারের মতো ওনার সাথে আমার দেখা হলো। ঠিক সেই কাবুলিওয়ালার ছোট্ট মেয়ের বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার আগে কাবুলিওয়ালার সাথে শেষবারের একঝলক দেখার মতো।
জানলার কাঁচ টেনে দিলাম, সমুদ্র আরও ভীষণভাবে দুরন্ত হয়ে উঠল বলে।
-শিল্পা প্রামানিক
YOU ARE READING
~HAWAII~
Viễn tưởngStory about the island Hawaii...created with the favourite person, with love and Imagination.
