ছোটোবেলা

3 1 0
                                        


আজ অফিস থেকে বেড়িয়ে রাস্তার মোড়ে এসে ক্যাব বুক করতেই চোখে পড়ল সেই রিকশা দাদুকে একটি বাচ্চা মেয়ের সাথে কথা বলতে। প্রতিদিনই অফিস থেকে বেড়োনোর সময় আমি এনাকে দেখতে পাই, খুব কম দিনই এমন হয় যেদিন তিনি থাকেন না। কিন্তু আজ একটু অবাক হলাম ওই বাচ্চা মেয়েটিকে একা ওনার সাথে দেখে। আমি রোজ এই রাস্তায় এসে ক্যাব বুক করি, এবং ক্যাব এলে চলে যায়। আজ কেমন যেন মনে হল, তাই ক্যাবটা বুক করতে করতেও বন্ধ করে একটু দাঁড়িয়ে থাকলাম রাস্তার মোড়েই। কিছুক্ষন পর দেখলাম ওই মেয়েটাও হাসতে হাসতে চলে গেল। আর রিকশা দাদুও তাকে টাটা করে তার দিকেই চেয়ে রইল যতক্ষন তাকে দেখা গেল। কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "যাবে?" তিনি বললেন, "যাবো! কোথায় যাবে বলো?" আমি খুব আনমনে বলে ফেললাম, "ছোটোবেলায়।", উনি " কী?" জিজ্ঞেস করতেই আবার বললাম, "তেতুলতলা, সেই রাস্তার ধারে বড়ো বটগাছের পাশে যে একচালা বাড়ি আছে, সেখানে।" রিকশা দাদু বলল, "বসো, কুড়ি টাকা নেবো।" আমি ঘাড় নাড়িয়ে বসে পড়লাম রিকশায় উঠে। কিছুক্ষনের স্তব্ধতা ভেঙে দাদু জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি তো চার চাকায় করে রোজ উল্টোদিকে যাও, আজ হঠাৎ এই রাস্তায় যাচ্ছো?" বললাম, "উল্টোদিকে আমার বড়োবেলা, এদিকে ছোটোবেলা।" দাদু হেসে উড়িয়ে দিলেন, হয়ত বুঝলেন না আমার কথা। সঠিক স্থানে নামিয়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন টাকা নিয়ে।

একচালা ঘরটার দিকে তাকিয়ে মনে পড়ল ছোটোবেলার এক ঝলক। রান্নাঘরের দরজায় বসে ঠাম্মির বানানো আলুভাজার জন্য অপেক্ষা করা। সেই তেল চিপচিপে আলুভাজাকে "too much oily food বিতানের জন্য ভালো নয় মা, এগুলো কেন বানাও বলতো?" বলে প্লেট সরিয়ে দেওয়া আমার মা ও খুব কেঁদেছিল তার চলে যাওয়ার দিন। সেদিনই প্রথম বুঝেছিলাম অত্যাধুনিক আমার মায়েরও কষ্ট হয়।

বারোটা বছর কেটে গেছে আমরা এই বাড়িতে আসিনা। ঠাম্মি মারা যাওয়ার পর থেকেই আমরা ফ্ল্যাট নিয়ে বড়োবাজারে সেটল হয়ে যায় তেতুলতলার বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে। অবশ্য আমার মা বাবার বিশাল বিলাস বহুল বাড়ির ধার কখনই ধারেননি আমার ঠাম্মি। তিনি চিরকাল এই একচালা বাড়িতেই কাটিয়েছেন। মূলত ঠাম্মির জন্যই আমাদের তেতুলতলায় বাড়ি করা হয়েছিল কাছাকাছি থাকব বলে, আর তার মারা যাওয়ার পরেই আমরা বড়োবাজার চলে যাই। ঠাম্মির মারা যাওয়ার গল্প আমি শুনিনা মা বাবা কারোর মুখেই। ওনারা নিজেদের জীবন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে এসব ভাবার সময় নেই। বাড়িটার কাছে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতেই ফোন বেজে উঠল। মায়ের ফোন, ফোন তুলতেই ওপার থেকে আওয়াজ এল, "কি রে এত দেরি হচ্ছে কেন তোর? আমি সন্ধ্যেটা প্ল্যান করে রেখেছি রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য, আমরা তো অপেক্ষা করছি তোর, তাড়াতাড়ি আয়।"

আমি বললাম, "মা! তুমি আমায় একটু ঘরে খাবার বানিয়ে দেবে আজ?"

মা চিন্তিত হয়ে বলল, "সে কি? তুই বাইরে খাবি না কেন?"

আমি উত্তরে বললাম, "শরীরটা ভালো লাগছে না।"

মা বলল, "ঠিক আছে! বল কী খাবি? আমি বানিয়ে দিচ্ছি। তবে অফিসের লোকজন ও পার্টিতে থাকবে বাবু! আমায় আর বাবাকে সেখানে যেতেই হবে।"

আমি জানতাম এর উত্তর অনেক আগে থেকেই, তাই আর কথা না বাড়িয়ে বলে ফেললাম, "তেল চিপচিপে আলুভাজা বানাও, মা! যতটা oily আমার জন্য ভালো নয়, ঠিক ততটাই তেল চিপচিপে।" বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। ডুবে গেলাম আবাদ গভীর ভাবনায়। হঠাৎ একটা আওয়াজে চমকে উঠলাম, "একি তুমি যাওনি এখনো?" পিছনে ঘুরে দেখি সেই রিকশাদাদু। আমি বললাম, "নিয়ে যাবে আমায়?" দাদু জিজ্ঞেস করলেন, "কোথায় যাবে বলো? নিয়ে যাবো।"

আমি আবার আপন মনে বললাম, "আমার বড়োবেলায়।"

আমরা যেতে শুরু করলাম। পিছনে পড়ে রইল রিকশার চাকায় গুড়ো গুড়ো হওয়া শুকনো পাতার আওয়াজ, একচালা বাড়ি আর আমার তেল চিপচিপে আলুভাজার গন্ধ।

-শিল্পা প্রামানিক

~HAWAII~Where stories live. Discover now