-নিশি ! ছাতাটা একটু নামিয়ে রাখবো ?
নিশি আমার দিকে এমন শীতল দৃষ্টিতে তাকালো যেন আমি ওর কাছে ওর কিডনি দুটো চেয়েছি !
নিশি তোমার কিডনি দুইটা আমাকে দিবা ?
আশ্চার্য ।
আমার মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে এতো সুন্দর চেহারার মানুষ এতো কঠিন করে তাকায় কিভাবে ? আর আমি অযৌক্তিক কিছু বলেছি বলে তো মনে হচ্ছে না ।
চারিদিকে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে । আমি আর নিশি ভার্সিটি থেকে আজিমপুরের দিকে যাচ্ছিলাম । ওর এক কোন চাচা না মামার বাসায় । আমার দায়িত্ব পরেছে ওকে ঐ বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসা তারপর আবার একই রিক্সায় ফেরত্ আসা ।
যে রিক্সাটা ঠিক করেছি সেটা নিশির পছন্দ হয় নাই । আরে বাবা রিক্সাই তো এতে আবার পছন্দ আর অপছন্দের কি আছে ?
কিন্তু এই মেয়েদের মন ! কখন কোন টা কিভাবে আর কেন যে পছন্দ করবে আবার পছন্দ করবে তা স্বয়ং উপরওয়ালা ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না । আমি তো অনুমানও করতে পারি না ।
রিক্সাতে উঠেই তাই নিশির মেজাজ একটু খারাপ ছিল । নীলক্ষেত মোড় পার হয়েছি এমন সময় কোথা থেকে যেন ঝুম বৃষ্টি আরাম্ভ হয়ে গেল । আমি রিক্সাওয়ালা মামাকে বললাম
-মামা জলদি পর্দা বের করেন ।
রিক্সাওয়ালা দাঁত বের করে বলল
-মামা নাইক্কা । আপারে একটু ধইরা বসেন তাইলে আর ভিজবেন না ।
এই বলেই রিক্সাওয়ালা আবার দাঁত বের করে হাসি দিল যেন খুব মজার কিছু বলেছে ! আমি নিশির দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখ গম্ভীর । ও যেন আগেই জানতো এমন কিছু হবে ।
মুখ গম্ভীর করলেও নিশি কিছু বলল না । হাত ব্যাগ থেকে একটা ছাতা বের করে দল আমার দিকে । রিক্সার হুড আর ছাতি দিয়ে বৃষ্টি আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলাম । কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না । কিছুক্ষনের ভিতর আমরা দুজনেই ভিজে গেলাম । এই জন্য ছাতাটা নামিয়ে রাখতে বলছিলাম ।
বৃষ্টির পানি এমনিতেই ঠান্ডা লাগছে নিশি তার থেকেও ঠান্ডা গলায় বলল
-তোমার কি এখন ঢং করতে ইচ্ছা করছে ? একসাথে রিক্সায় করে দুজন বৃষ্টিতে ভিজবো এন্ড অল দ্যাট ?
আমি খানিকটা সংকুচিত গলায় বললাম
-না মানে এমনিতেই তো ভিজে যাচ্ছি । খামোখা ছাতি ধরে রেখে লাভ কি ?
-চুপচাপ ধরে রাখ ।
আমি ছাতি ধরে বসে রইলাম ।
এই মেয়েটা ইদানিং আমার উপর এমন কর্তৃত্ব ফলায় । আগেই ভাল ছিল । আমরা বন্ধু ছিলাম । এখন সে আমার মেয়ে বন্ধু ইংরেজিতে যেটাতে গার্লফ্রেন্ড । আসলেই কোন মহান লুল গল্পকার বলেছিল ফ্রেন্ড যখন গার্লফ্রেন্ড হয় তখন কত ঝামেলাই সৃষ্টি হয় ! আমি এখন সেই ঝামেলা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি ।
অবশ্য আগেও নিশি আমার উপর কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করতো কিন্তু কেবলই বন্ধু হবার কারনে গলায় জোর ছিল কম ।
একদিন নিশিকে নিয়ে নিউমার্কেটে গেছি । ও কেনাকাটা করছে আর ব্যাগ গুলো আমার হাতে দিয়ে বলল
-এগুলা ধর তো !
আমি খানিকটা ভাব নিয়ে বললাম
-তোর ব্যাগ তুই ধর । আমাকে তোর বয়ফ্রেন্ড পেয়েছিস নাকি ?
নিশি এমন একটা মুখভাব করলো যেন এর থেকে অবাক হওয়ার কথা সে আর শোনেই নি । কেবল বলল
-দাড়া তোকে মজা দেখাচ্ছি ।
আসলেই কদিনের ভিতরেই ও আমাকে মজা দেখিয়ে ছাড়ল । এখন নিশি কোথাও গেলেই আমাকে ওর সাথে সাথে যেতে হয় আর বাধ্য বয়ফ্রেন্ডের মত ওর কেনাকাটার ব্যাগ টানতে হয় ।
আগে তো কোন একটা বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি হত কিন্তু এখন সে বাকশালী সরকারে পরিনত হয়েছে । যা বলবে তাই শুনতে হবে ।
একবার মন বিদ্রোহ করে উঠেছিল । বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যাবার প্লান ছিল । যদিও সময়টা ঠিক ছিল না । বর্ষাকালে কেউ সাধারনত সেন্টমার্টিন যায় না । তখন সাগর নাকি খুব উত্তাল থাকে । যাওয়াটা খানিকটা বিপদজনক । এই কথা শোনার পর থেকেই নিশির এক কথা আমার যাওয়া চলবে না । কিন্তু আমি যাবোই । ওর কথায় কানই দিলাম না । যেদিন সকালবেলা যাবো তার আগের দিন রাতে নিশি কাটার দিয়ে নিজের হাত কেটে ফেলল । রক্ততক্ত বের হয়ে কি অবস্থা ! ডাক্তার কাছে নিয়ে যাওয়া হল সেই রাতেই । ভাগ্যভাল যে হাতের রগ কাটে নাই । তবুও সেলাই দিতে হল । আমার যাওয়া বাতিল হয়ে গেল ।
তারপর থেকেই আমি চুপ । মেয়েটার জন্য কেমন যেন একটা মায়া জন্মে গেছে । মনে হয় আমার জন্যই তো এমনটা করছে ।
করি না হয় সহ্য !
বৃষ্টির বেগ যেন প্রতি মুহুর্তে বাড়ছে । সেই সাথে বাড়ছে বাতাস । রিক্সাওয়ালা একটা বড় গাছের কাছে এসে রিক্সা থামিয়ে দিল । আমার কিছু বলার আগেই নিশি রিক্সাওয়ালাকে একটা ধমকের সুরে বলে উঠল
-কি ব্যাপার রিক্সা থামালেন কেন ?
-আফা মনি খুউব বাতাস দিতাছে । চালাইতে পারি না ।
আসলেই খুব বাতাস দিচ্ছে । সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টি । এর ভিতর রিক্সা চালানো একটু কষ্টকরই বটে ।
রিক্সা ছেড়ে দিলাম । নিশির সেই মামা নাকি চাচার বাসা খুব বেশি দুরে না । হেটে গেলে দশ পনের মিনিট লাগবে ।
একটা ছাতা নিয়ে আমি আর নিশি হাটতে লাগলাম বৃষ্টির ভিতর । একটু দুরে গেছি তখনই একটা বাতাসের ঝটকা এল । এতো জোড়ে যে আমার হাত থেকে ছাতি উড়ে গেল । মাথার উপর থেকে ছাতি সরে যেতেই যেটুকু ভিজতে বাকি ছিল সেটুকুও ভিজে গেল । নিশি আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবার আগেই আমি বললাম
-দেখ । আমি কিছু করি নাই ।
এই বলে যখন ছাতার পিছনে দৌড় দিলাম । ছাতা এনে দেখি নিশি দুই হাত মেলে বৃষ্টিতে ভিজছে । ওর মুখে একটা নমনীয় ভাব । আমি কাছে এসে ছাতা মেলতে গেলে ও বলল
ওটার আর দরকার নাই । চল ।
আমি ছাতা বন্ধ করে নিশির পাশে হাটতে লাগলাম ।
কি চমত্কার একটা সময় !
চারিদিকে বৃষ্টি পড়ছে । আমি আর নিশি পাশাপাশি হাটছি । যে কোন প্রেমিক প্রেমিকার জন্যই এটা একটা স্বরনীও মুহুর্ত !
এখন কেবল নিশির হাতটা ধরতে পারলেই হল ।
আমি আমার সেন্ডেল খুলে হাতে নিলাম । নিশিও তাই করলো । সেন্ডেল আর ছাতাটা একই হাতে নিলাম যাতে করে অন্য হাতটা ফাঁকা থাকে ওর হাত ধরার জন্য । ওকে হাত ধরতে বলবো কিনা ভাবছি ঠিক এই সময়েই ও আমার হাত ধরলো ।
ঠান্ডা বৃষ্টির পানিতে একটু একটু কাঁপছিলাম । নিশির হাতটা ধরে বুকের ভিতরেও ঠিক একই রকম কাঁপন অনুভব করতে শুরু করলাম ।
বৃষ্টির বেগ বাড়ছেই । আমার সেদিকে আর খিয়াল নেই । আমি নিশির হাত ধরে হাটছি । কেন জানি পৃথিবীর সব থেকে সুখি মানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে ।
YOU ARE READING
বুক পকেটের গল্পরা (ভলিউম ০৩)
Short Storyব্লগে গল্প লিখছি সেই ২০১১ সাল থেকে । অনেক গল্প সেখানে জমা হয়ে গেছে । সেই গল্প গুলোই আস্তে আস্তে এখানে এনে জমা করা হচ্ছে । দুইটা ভলিউম এর আগে প্রকাশ হয়েছে ।