-কি করতে বলিস ?
রাফি সুমনর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন । সুমন বলল
-আরে তুই যে নুপুরকে ভালবাসার কথা বলবি তা ও বুঝবে কিভাবে শুনি ? কেবল ফুল দিলেই কি কাজ হবে ? মুখে বলতে হবে না ?
-ও কি বুঝতে পারে না আমার কথা ? আমি বলতে পারবো না । বুঝলে বুঝবে না বুঝলে নাই !
সুমন একটু বিরক্ত হল । বলল
-দেখ কেবল ফুল দিয়ে ফুল হবি না । আমি যা বলছি তাই শোন ।
রাফির তবুও সংশয় কাটে না । আসলে রাফির বিশ্বাসটা অন্য জায়গায় । ও মনে করে ভালবাসা হল মনের ব্যাপার । কেবল মন দিয়েই এই ভালবাসা কে উপলব্ধি করা যায় । মুখের ভাষার খুব একটা দরকার নাই সেখানে ।
মুখের ভাষা দরকার হয় কেবল দৈন্দিন কাজের জন্য । মনের ভালবাসা প্রকাশের জন্য মুখ দিয়ে ভালবাসি বলার কি খুব একটা প্রয়োজন আছে ?
রাফির তো মনে হয় কেবল একবার চোখের দিকে তাকালেই মানুষের বুঝে ফেলার কথা যে সামনের মানুষটি তাকে ভালবাসে কি না !
আর রাফির কেবল মনে হয় যদি মুখ দিয়ে বলতেই হয় তাহলে আর কেমন ভালবাসলাম । সুমন আর রাফি প্রতিদিন সকাল বেলায় এই রমনা পার্কে আসে দৌড়াতে । আজকে দৌড়ানো শেষে দুজন বসে এই নিয়ে আলাপ করছিল । আসলে রাফি অনেক দিন থেকেই নুপুরকে পছন্দ করে ।
ওকে প্রোপোজ করবে ভাবছে !
রাফির মনে হয় নুপুরও ব্যাপারটা ঠিকই বুঝতে পারে । হয়তো লজ্জায় কিছু বলতে পারে না !
-দেখ ! যা বলবি সরাসরিও বলবি ! না হলে কিন্তু ও বুঝবে না !
-না বুঝলে নাই !
-আরে .....
-মুখ দিয়ে বলার দরকার আছে ?
রাফি আর সুমন একটু চমকালো ! ভরাট গলার একটা কন্ঠ থেকে লাইন টা এল ওদের ঠিক পেছন থেকে । দুজনেই একসাথে পেছনে তাকিয়ে দেখে একটা বৃদ্ধ পরের একটা বেঞ্চে বসে আছে ।
বৃদ্ধের চোখে কালো মোটা গ্রেমের চশমা ! চুল গুলো প্রায় সবই পেকে গেছে । বয়স ৬০ থেকে ৬৫ হবে হয়তো ! তবে শরীর এখনও মোটামুটি ভাল আছে !
বৃদ্ধ আবার হাসি মুখে বলল
-কি দরকার আছে ?
ওরা দুজনেই একটি সংকোচ বোধ করছে জবাব দিতে ! আসলে ঐ বৃদ্ধর কাছ থেকে ওা এই কথাটা ঠিক আশা করেন নেই !
বৃদ্ধ আবার বলল
-কি হল কথা বলছো না কেন ?
রাফি আর সুমন একসাথে বলে উঠলো !
-নেই ।
-আছে ।
বৃদ্ধ হেসে উঠল ! হাসতে হাসতে নিজের বরঞ্চ থেকে উঠে এসে ওদের বঞ্চে এসে বসলো ! বলল
-শুনো ! যাকে ভালবাসবে তাকে সেটা নিজের অনুভুতি দিয়ে বোঝাবে ! মুখে ভাষা দিয়ে নয় !
রাফি খুশি হল ।
সুমনকে বলল
-দেখেছিস ? আমি কি বললাম !
সুমনও কম যায় না ! বলল
-তাই কি হয় নাকি ! তার পর বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল
-আচ্ছা দাদু আপনি বলেন এটা কি সম্ভব ?
বৃদ্ধ বলল
-কেন সম্ভব না ?
-মনে করেন একটা অপরিচিত মেয়েকে পছন্দ করেন । প্রতিদিন রাস্তায় যাওয়ার সময় তার সাথে আপনার দেখা হয় । আপনি যদি তাকে নাই বলেন ভালবাসি তাহলে সে কিভাবে বুঝবে !
বৃদ্ধ আবারও হাসলো ।
-বুঝবে হে বুঝবে ! ভালবাসলে ঠিকই বুঝবে । তোমাদের একটা গল্প শোনাই ! শুনবে ?
রাফি আর সুমন দুজনেই দুজনের দিকে তাকালো । ওদের কারোই এখন কোন কাজ নাই । শোনা যায় !
বৃদ্ধ গল্প শুরু করলো !
আমার বয়স তখন খুব বেশি না ! নিউজার্সিতে থাকি ! সবে মাত্র পড়া লেখা শেষ করে চাকরী পেয়েছি ! অফিসের পরিবেশের সাথে এখনও ঠিক মত নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি নি !
প্রতিদিন সময় মত অফিসে যাই । কাজ করি আবার চলে আসি ! পানসে আর বিরক্তিকর জীবন !
এর মাঝে একটা কথা বলে নেই । আমার ঠিক পাশের বিল্ডিংয়ে একটা মেয়ে কাজ করতো ! আমি যেখানে বসতাম সেখান থেকে মেয়েটার ডেস্ক দেখা যেত !
প্রতিদিন দেখতাম মেয়েটা কম্পিউটারের সামনে গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ কাজ করছে । আমি মাঝে মাঝে কাজকর্ম বাদ দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম !
অন্যসব মেয়েদের মতই মেয়েটা দেখতে কিন্তু একটা বিশেষত্ব ছিল সেটা হল মেয়েটার মাথা ঘনকালো চুল ছিল ! এমনটা সাধারনত খুব একটা দেখা যায় না ! আমি প্রতিদিন মেয়েকে দেখতাম ।
একদিন একটা অবাক করা বিষয় হল !
রাফি আর সুমন একসাথে বলে উঠলো
-কি ?
বৃদ্ধ কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল ! হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখলো ! তারপর বলল
-বাচ্ছারা আজকে এই পর্যন্তই থাক । কালকে আবার ।
-এটা কেমন কথা ?
বৃদ্ধ হেসে বলল
-আমার বউকে তো চেনো না । হাটার নাম করে যদি দেখে আমি এখানে বসে বসে তোমাদের সাথে আড্ডা মারছি তাহলে আমার খবর খারাপ হয়ে যাবে ! আম যাই !
বৃদ্ধ আর দাড়ালো না । চলে গেল !
রাফি আর সুমন কেবল একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ী করতে লাগলো !
-হুম ! তো আমি কালকে কোথায় ছিলাম ?
-ঐ যে একটা অবাক হওয়ার বিষয় !
-ও আচ্ছা ! শোন তাহলে !
বৃদ্ধ আবার শুরু করলো !
আমি কাজ করার ফাঁকে ফাঁকেই মেয়েটার দিকে তাকাতাম । একদিন যতবারই মেয়েটার দিকে তাকাই দেখি মেয়েটা কিবোর্ডের কাজ ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমি লজ্জায় পড়ে যাই । সঙ্গে সঙ্গেই চোখ ফিরিয়ে নেই । কিন্তু আবার আপনা আপনিই আমার চোখ চলে যায় জানলার দিকে !
দেখি মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়েই আছে !
আমি আবার চোখ ফিরিয়ে নেই !
এর পর হল সব থেকে অবাক হওয়ার বিষয় !
মেয়েটি একটা এফোর সাইজের কাগজে আমর দিকে তুলে ধরলো ! কিছু একটা লেখা ছিল ! লেখাটা পড়েই আামর মুখটা ছোট হয়ে গেল !
কালো মার্কার দিয়ে ইংরেজিতে লেখা !
"আমার একটা ছবিই না হয় তুলে নাও" !
আমি ঠিক করলাম যে আর মেয়েটার দিকে তাকাবো না । তাকাবোই না ! কিন্তু তাকাবো না তাকাবো না করেও ঠিকই তাকিয়ে ফেললাম
দেখলাম মেয়েটা আবার একটা কাগজ আমার দিকে তুলে ধরেছে ।
এভার আমার মনটা ভাল হয়ে গেল !
ওখানে একটা স্মাইলী দিয়ে লেখা ছিল "আই ওয়াজ জোকিং" !
মেয়েটা ওর নাম জানলো স্ট্রেসী !
তারপর আস্তে আস্তে স্ট্রেসী সাথে আমার একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো ! কিন্তু মজার ব্যাপর হল আমাদের মাঝে কোন কথা হত না । কোন মেইল আদান প্রদান হত না ! আমরা কেবল কাগজে মার্কার দিয়ে লেখা দিয়ে কথা বলতাম । তা খুব একটা বেশি না ! টুকটাক !
একদিন স্ট্রেসী আমাকে বলল যে আমি যেমন তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম সেও ঠিক একই ভাবে আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতো !
মনের ভিতর একটা সাহস চলে এল ! মনে হল এবার মনে স্ট্রেসী সাথে দেখা করা যায় ! কাগজে বড় বড় করে লিখলাম "তুমি কি আমার সাথে দেখা করতে চাও" ?
কাগজটা একটু ভাল করে দেখেনিলাম ! স্ট্রেসী কে দেখাবো কি না ভাবছি ! এমন সময় দেখি স্ট্রেসীর কাছে একটা লোক এল । জানলা দিয়ে যতদুর দেখলাম স্ট্রেসী তার সাথে তার ডেস্ক ছেড়ে চলে গেল ! আমি কাগজটা নিয়ে বসে রইলাম তাকে দেখানোর জন্য !
ঐ দিন স্ট্রেসী আর ফিরেই এল না ! আমি কাগজটা বুক পকেটে নিয়েই বসে রইলাম !
-তারপর !!
-তারপর ??
ওরা দুজনই একসাথে বসে চিৎকার করে উঠলো !
বৃদ্ধ কিছুক্ষন চুপ করে রইলো ! তারপর বলল
-তারপর দিন দুয়েক স্ট্রেসীর কোন খোজ নাই ! দেখলাম ওর ডেস্কে একজন নতুন এমপ্লয়ী এসেছে !
-মানে কি ?
-কোন মানে নাই ! কেন জানি মনে হল স্ট্রেসী জব ছেড়ে চলে গেছে । অথবা ওর চাকরী চলে গেছে ।
-তারপর ? আপনি কি করলেন ?
বৃদ্ধ গত দিনের মত নিজের ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল
-আজকে আর সময় নাই বাচ্চারা ! আবার কালকে । তোমাদের দাদী দেখলে আমার খবর আছে !
বৃদ্ধ চলে যাওয়ার পরেই রাফি বলল
-আরে ধুর এর কোন মানে আছে ?
-গল্পটা শেষ করে যাবে তো !
-হুম !
সুমন বলল
-দেখলি তো উনি কিছু বলেননি তাই স্ট্রেসী ভেগেছে । তুইও যদি কিছু না বলিশ তাহলে নুপুরও ভাগবে কিন্তু ! আর দেরী করিস না । বলে দে বললাম !
-কি ব্যাপার ! আজকে তোমার বন্ধু কই ?
বৃদ্ধ বসতে বসতে রাফিকে প্রশ্ন করলো !
-ও আজকে আসবে না ! আপনি আপনার গল্প শেষ করেন ! তারপর কি হল ?
-তারপর ??
বৃদ্ধ আবার তার গল্প শুরু করলো !
আসলে স্ট্রেসীর চলে যাওয়ার পর ওর প্রয়োজনীয়তা টা আবার বুঝতে পারলাম ভাল করে । ওকে সারাদিন মিস করতে শুরু করলাম ! আমার দিন আগে কি চমৎকার ভাবে কেটে যাচ্ছি এখন আবার কেকমন পানসে হতে শুরু করলো ।
তারপর কয়েকদি পরে বসে বসে কাজ করছি এমন সময় হঠাৎ করেই আমার মুখের উপর আলো আসতে লাগলো ! আমি খানিকটা বিরক্ত হয়ে জানালা বন্ধ করতে যাবো ঠিক তখনই আমার চোখ পাশের বিল্ডিংয়ের উপর তলার দিকে গেল !
সেখানে দেখি স্ট্রেসীর দাড়িয়ে ! একটা আয়না নিয়ে ও এতোক্ষন আমা রমনযোগ আকর্ষন করার চেষ্টা করছিল ! আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো ! তারপর একটা কাগজ আমার দিকে ধরলো । সেখানে লেখা
সে প্রোমশোন পেয়েছে । এই জন্য ডেস্ক বদলেছে
আমি কেবল অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার বুকের ভিতর একটা অচেনা তোড়পাড় শুরু হয়েছে । আমি একটুও দেরি না করেই বুক পকেটের ভাজ করা কাজগটা বের করলাম !
মেলে ধরলাম স্ট্রেসীর সামনে !
"তুমি কি আমার সাথে দেখা করতে চাও" ?
স্ট্রেসীর একটু হাসলো ! তারপর আবার ডেস্কের দিকে চলে গেল ফিরে এল কিছু পরেই । সেখানে লেখা
"ভেবেছিল তুমি হয়তো কোন দিন বলবেই না" !
বৃদ্ধ একটু চুপ করলো !
রাফির যেন আর তর সইছিল না ।
-তারপর ? তারপর কি হল ?
-তারপর ?
-রবিউল করিম !!
পেছন থেকে একজন মহিলা কন্ঠ খানিকটা কঠিন কন্ঠে বলে উঠলে !
বৃদ্ধলোকটা আর রাফি এস সাথে পিছন ফিরে তাকালো ! দুজনের চোখেই খানিকটা বিশ্ময় ! তবে রাফি অবাক হল যে যে কথাটা বলেছে সে একজন বিদেশী । চেহারায় স্পষ্টই বিদেশী একটা ভাব । তবে তার উচ্চারিত বাংলা বিদেশীদের মত না ! একদম বাঙালীদের মত । বয়সে বৃদ্ধের কাছাকাছিই হবে ।
হন হন করে সে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে এল বিদেশী বৃদ্ধা !
-এই জন্যতো বলি ডায়বেটিস কেন তোমার বেড়ে যাচ্ছে । হাটার নাম করে এখানে বসে বসে আড্ডা মারা হচ্ছে ?
-আরে এই সব কি বল ? আমি তো ....
-কোন কথা না ! তুমি তো চাও না আর কটা দিন বেশি বাঁচো ? নাকি আমার সাথে থাকতে ভাল লাগছে না !
বৃদ্ধ হেসে বলল
-আরে কি বল ! তুমি আমার ......।
-হয়েছে । মানুষজেনর সামনে আর ঢং করতে হবে না । চল ! এখনই চল !
বিদেশী বৃদ্ধা রবিউল করিমকে নিয়ে চলে গেল । রাফি বসে বসে দুই বুড়োবুড়ির খুনসুটি দেখতে লাগলো ! বিদেশী বৃদ্ধা রাগ করা চেষ্টা করছে আর বৃদ্ধ তাকে মান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে !
রাফির গল্পের শেষটা অনুমন করে নিতে পারলো ! আচ্ছা বৃদ্ধ রবিউল করিম কি স্ট্রেসীকে আই লাভ ইউ বলেছিল মুখ দিয়ে ?
এটা তো জানা হল না !!
(একটা শর্ট ফিল্ম দেখেছিলাম । নাম "সাইন" । আমার কাছে অসাধারন লেগেছিল । সেই শর্ট ফ্লিমের কাহিনী অবলম্বনে গল্পটা লিখলাম)শর্ট ফিল্মটা উপরে যুক্ত করে দিলাম !
YOU ARE READING
বুক পকেটের গল্পরা (ভলিউম ০৩)
Short Storyব্লগে গল্প লিখছি সেই ২০১১ সাল থেকে । অনেক গল্প সেখানে জমা হয়ে গেছে । সেই গল্প গুলোই আস্তে আস্তে এখানে এনে জমা করা হচ্ছে । দুইটা ভলিউম এর আগে প্রকাশ হয়েছে ।