-ভাইজান লইয়া জান ! এর থেকে সস্তা আর পাইবেন না !
আমি বড় বোয়াল মাছটার দিকে একবার তাকালাম আর একবার মাছ বিক্রেতার দিকে তাকালাম ।
আসলেই লোকটা ঠিক কথা বলছে । এত বড় মাছ এর থেকে সস্তায় আর পাওয়া যাবে না । গত পরশু দিনও এর থেকে ছোট বোয়াল মাছের দাম এখন কার থেকে ১০০ টাকা বেশি ছিল ! প্রথমে দাম শুনে আমি খানিকটা সন্দেহ করেছিলাম । পচা না তো ?
অথবা বরফ দেওয়া চার পাঁচ দিনের পুরানো মাছ ! কিন্তু হাত দিয়ে দেখলাম একদম তাজা !
বড় মন চাইলো মাছটা কিনতে। ঢাকায় আসার পর কত দিন এতো বড় মাছ খাওয়া হয় না !
কিন্তু উপায় নাই !
একদমই উপাই নাই !
মাছওয়ালা আবার জিজ্ঞেস করলো
-কি মামা নিবেন না ?
-না মামা উপায় নাই !
-কি বলেন ? এতো কমে দিতাছি তবুও নিবেন না ?
-না মামা সেই জন্য না ! টাকা সমস্যা না । সমস্যা হল আমি একা মানুষ । এতো বড় মাছ খেয়ে শেষ করতে পারবো না ! নষ্ট হবে ।
-কেন ফ্রীজ আছে না ? ফ্রীজে রাখবেন !
আমি খানিকটা কষ্টের হাসি হাসলাম । ফ্রীজ থাকলে কি আর আমি এতো ইতস্ততঃ করি ? বললাম
-নাহ মামা ! ফ্রীজ নাই ।
আমার ফ্রীজ নাই শুনে মাছওয়ালা কেমন চোখে তাকালো ।
একটু আগে যে চোখে দেকখছিল এখন যেন সেই চোখে দেখছে না । আমি বললাম
-হাফ বিক্রি করা যাবে না ? এই মনে করেন মাছটা কেটে যদি অর্ধেক আমাকে দিলেন ! বাকীটা অন্য কাউকে !
আমার কথা শুনে মাছ ওয়ালা এমন ভাবে হাসলো যেন এর থেকে হাস্যকর কথা আর জীবনে শুনেই নাই !
মাছ না কিনেই ফিরে আসতে হল । দেখি অন্য কোন দোকানে ছোট কোন মাছ পাওয়া যায় নাকি ?
অন্য কয়েকটা দোকানে ঘুরেও কোন লাভ হল না ! অন্য কোন মাছ কিনতেই ইচ্ছে হল না । একবার যে জিনিসটা ভাল লেগে গেছে সেটা ছাড়া আর কিছুই ভাল লাগবে না !
আমি বাজার থেকে বের হয়ে এলাম । যাহ শালা !
আজকে মাছই কিনবো না !
-শুনুন !
বাজার থেকে বেরিয়ে হাটা দেব এমন সময় একটা মেয়ে গলা আমাকে পিছন থেকে ডাকতেছে । একটু অবাক হতে হল ! ঢাকায় আমার পরিচিত খুব একটা নাই ! মেয়ে তো আরো নাই । ডাকে কে ?
তাকিয়ে দেখি সবুজ রংয়ের একটা সেলোয়ার কামিজ পরা মেয়ে আমাকে ডাকছে । চেহারাটা মিষ্টি হলেও এমন আহামরি সুন্দরী কেউ না । এবং সে আমার অপরিচিত !
আমি বললাম
-আমাকে বলছেন ?
-জি !
মেয়েটাকে একটু বিব্রত মনে হল ! যেন আমাকে ডেকে মেয়েটি বড় খারাপ একটা কাজ করে ফেলেছে ।
-জি বলুন !
-আসলে ?
মেয়েটি আবার ইতস্ত করতে লাগলো ! আমি বললাম
-কোন সমস্যা নাই । বলুন !
-আসলে ঐ মাছটার ব্যাপারে কথা বলছিলাম ।
-কোন মাছটা ?
-ঐ যে বোয়াল মাছটা !
-কি ব্যাপার বলুন তো !
আমার মনে খানিকটা কৌতুহল হল ! ঐ মাছটার ব্যাপারে আবার কি বলার আছে ।
মেয়েটি একটু দম নিল ! তারপর বলল
-দেখুন এটা শুনতে কেমন একটু অন্য রকম লাগে । তবুও বলি । আমি আসলে আপনার পাশেই দাড়িয়ে ছিলাম । আপনার কথা বার্তা শুনছিলাম । আপনার যে সমস্যা আমারও ঠিক একই সমস্যা ! আমিও চাইলেই বড় মাছ কিনতে পারি না । ফ্রীজ নাই সেই জন্য ! কিনলে নষ্ট হয় !
-ও আচ্ছা !
আমার ঠিক মাথায় ঢুকছে না মেয়েটি আসলে কি বলতে চায় !
-আমার কাছে কি চান বলুন !
-আমরা একে অন্যের কাজে আসতে পারি !
-কিভাবে ?
-মানে যদি আমরা দুজন মিলে মাছটা কিনি তাহলে মনে হয় আমাদের দুজনেরই ইচ্ছাটা পুরন হয় । আর মাছ নষ্টও হবে না ।
আমার মুখ উজ্জল হয়ে উঠল । আরে তাই তো !
এমন তো হতেই পারে !
আমি তো মাছ ওয়ালাকে তাই বলে আসলাম । ব্যাটা কোন পাত্তাই দিল না ।
এখন ?
আমি বললাম
-তাহলে তো খুব ভাল হয় !
আমার আসলেই কোন ধারনা ছিল না যে এমন একটা প্রস্তাব আসতে পারে !
যখন ভার্সিটিতে পড়তাম তখন রুমমেটরা একসাথে মিলে ইন্টারনেটে বিল শেয়ার করতাম । কিন্তু একসাথে মাছ শেয়ার করে কেনা টা এই প্রথম !
আমাদের আবার আসতে দেখে মাছওয়ালা মামা একটু বিরক্তই হল ! কিন্তু যখন আমরা মাছ টা কাটার কথা বললাম তখন আর মুখে তার কোন বিরক্তি ছিল না !
মাছ কাটা কুটির পরে এবার মতুন একটা সমস্যা হল । কে কোন ভাব নিবে সেট নিয়ে ! আমি মনে মনে মাছের মাথাটা নিতে চাইলেও সরাসরি কিছু বলতে পারলাম না । মেয়েটা আবার কি মনে করবে !
কিন্তু দেখলাম মেয়েটাই এর চমৎকার সমাধান করে দিল । এবং মেয়েটার কথা শুনে আমি খানিকটা চমৎকৃতও হলাম ।
মেয়েটি বলল
-আপনি বরং মাছের মাথাটা নিন আজকে !
-না ! ঠিক আছে । আমার কোন সমস্যা নাই । একটা হলেই হল ।
মেয়েটি আমার কথা শুনে একটু হালো ! তারপর বলল
-না ! আজকে আপনি নিন । মাছটা আপনি যেহেতু আগে পছন্দ করে করেছেন আপনি নিন ! সামনে যেদিন আবার একসাথে কিনবো সেদিন না হয় মাথাটা আমি নেব ! ঠিক আছে ?
আমি খুশি হয়ে বললাম
-খুব ঠিক আছে ।
এর পর আমরা একসাথে একটা বড় মিষ্টি কুমড়া কিনলাম । যথা রীতি ভাগ করে নিলাম। বাজার শেষে যখন একসাথে বের হলাম তখন যে কেউ আমাদের দেখলে মনে করবে আমরা আসলে কাপল । একসাথে বাজার করতে বেরিয়েছি !
মেয়েটির সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম । এই কোথায় থাকে, কি নাম, কি করে ? সংসারে আর কে কে আছে ?
-তো আপনি একা থাকেন ?
-হুম ! ঐ যে হাউজিংয়ের শেষ মাথায় যে বাড়িটা ওটার চিলেকোঠায় ! আপনি কোথায় থাকেন ?
তিন নাম্বার গলিতে । একটা ফ্যামিলির সাথে সাবলেট ! আমি আর আমার ছোট্ট একটা বোন ! ও ক্লাস সেভেনে পড়ে ।
-আচ্ছা ভাল । আচ্ছা ! আজ তাহলে যাই !
-আচ্ছা !
মেয়েটি মিষ্টি করে করে হাসলো ! কিছুদুর গিয়েছি মেয়েটি আবার আমাকে ডাক দিল !
-এই যে শুনুন !
-জি !
-আপনার নামটাই তো জানা হল না ?
আমার নাম বললাম । মেয়েটিও প্রতি উত্তরে তার নাম বলল । নুপুর !
সুন্দর নাম !
নুপুর আমাকে বলল
-আপনি আবার কালকে কখন বাজারে যাবেন ?
-এই তো এই সময়ে !
-কালকেও আপনার সাথে বাজার করতে পারলে ভাল হত । পরশুদিন তো আবার শুক্রবার , একটা মুরগি কিনতাম এক সাথে !
-হ্যা ! কোন সমস্যা নাই !
-আপনার সাথে যোগাযোগ করবো কিভাবে ? আপনি ঠিক কখন আসবেন বলেন ?
-এই তো এই সময়েই ।
আমি কিছুক্ষন ভাবলাম । তারপর বললাম
-আচ্ছা ! আপনি আমার মোবাইল নাম্বারটা রাখুন ! আমাকে একটা ফোন দিলেই হবে !
তারপর থেকেই নুপুর আমার পার্টনার হয়ে গেল । প্রায় প্রতিদিনই আমরা একসাথে বাজার করতাম । মাঝে মাঝে এদিক ওদিক ঘুরতে যেতাম । নুপুরের সাথে ওর ছোট বোন টাপুরও থাকতো !
এই অচেনা শহরে কেন জানি এই দুজন আমার আপন জন হয়ে উঠলো ! দিন ভালই যাচ্ছিল । এমন সময় একটা ঘটনা ঘটলো যে আমার মনটা খানিকটা খারাপ হয়ে গেল !
সেদিন ছুটির দিন ছিল ! একটু সকাল সকালই নুপুর ফোন দিল ! ততদিনে আমরা ভাল বন্ধু হয়ে গেছি যদিও এখনও আপনিতেই আছি । সকালের দিকে নুপুরের ফোন ।
-কোন কাজ আছে এখন ?
-নাহ ! কেন ?
-এক জায়গায় যেতে হবে । যাবেন আমার সাথে ?
-আচ্ছা !
আমি ভেবেছিলাম কোথাও নিয়ে যাবে হয়তো আমাকে । কিন্তু সে আমাকে যেখানে নিয়ে গেল আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল ।
রাস্তার ভিতরেই সে আমাকে সব খুলে বলল !
বেশ কয়েক দিন ধরেই সে টাকা জমাচ্ছে ! একা ফ্রীজ কিনবে !
ফ্রীজ !!!
তারমানে আমাদের একসাথে বাজার করা শেষ ?
এখন থেকে ও সব কিছু একাই কিনতে পারবে ! একটা আস্ত বোয়াল মাছ আর ভাগ করে কিনতে হবে না !
দুজন মিলেই কিনলাম ফ্রীজ টা ! আমার মনটা খারাপ হয়েই রইলো ! যখন ওকে ফ্রীজ সমেত ওর বাসায় তুলে দিলাম মনে হল আর বুঝি হল না !
রাতে নুপুর নিজেই ফোন দিল ।
-একটা কথা জিজ্ঞেস করি ?
-করুন !
-আপনার মন খারাপ আজকে ?
-নাহ ! কেন ?
-না ! আমার মনে হয়েছে আপনার মন খারাপ । আমাকে বলা যায় ?
-না এমন কোন কারন নাই । মাঝে মাঝে এমন হয় ! একা একা থাকি তো !
-না ! আমি জানি অন্য কিছু !
আমি চুপ করে থাকি ! আসলে কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ।
নুপুর বলল
-আজকে যখন আমাদের দেখা হল তখনও কিন্তু আপনার মুড ঠিকই ছিল । কিন্তু যখন আমি ফ্রীজের কথা বললাম তখন থেকেই আপনার মুড অফ ! কেন ?
-নাহ ! এমন কোন বিষয় না !
-আমি জানি ! এটাই বিষয় ! আপনার মনে হয়েছে আপনি আপনার বাজার করা পার্টনার হারিয়েছেন তাই না ? এখন থেকে আমি আর আপনার সাথে বাজার করবো না তাই না ?
আমি চুপ লরে থাকি ! কোন কথার জবাব দেই না । আসলে দিতে মন চায় না । কি বা বলার আছে ?
নুপুর বলল
-এটা আপনার ভুল ধারনা ! আমি আমাদের পার্টনার শিপ কোন দিন ভাঙ্গবো না ! বুঝছেন ! আপন প্লিজ মন খারাপ করে থাকবেন না । এই ইট পাথরের শহরে আমি আর টাপুর আপনার উপর অনেকটা নির্ভর করি এখন সেটা কি আপনি জানেন ?
সেদিন রাতে আরো অনেক কথা হল ! অনেক অজানা কথা জানা হল ! মন খারাপ ছিল কিন্তু মন ভাল নিয়ে ঘুমাতে গেলাম !
দিন ভালই চলতে লাগলো ! এরই মাঝে এল নতুন এক ঘটনা !
নুপুরেরা যে বাসায় সাবলেট থাকতো সেই বাসার লোকের সাথে নুপুরের কি নিয়ে একটা কথা কাটাকাটি লেগে গেল । এমনই হল হল যে নুপুর আর থাকবে না বলে সিদ্ধান্ত নিল !
শুর হল নতুন ঝামেলা !
এখন এক রুমের বাসা কোথায় পাওয়া যায় ?
সাবলেটও পাওয়া যায় না !
সেই সময় টাপুর আমাকে একটা বুদ্ধি দিল ! আমরা দুজন মিলে একটা বাসা ভাড়া করতে পারি !
এই কথাটা আমার মনে অনেক আগেই এসেছে কিন্তু আমি সংকোচের কারনে বলতে পারি নি ! কিন্তু টাপুর বলাতে একটু স্বস্তি পেলাম ! নুপুরও রাজি হয়ে গেল ! এবার আমরা দুজন মিলে বাসা খুজতে লাগলাম !
দুইরুমের একটা ফ্লাট ! সাথে একটা কিচেন আর দুটা বাথরুম ! একচিলতে বারান্দ !
পেয়েও গেলাম !
রুম দেখার সময় বাধলো বিপত্তি !
বাড়িয়ালা আমাদের কে স্বামী স্ত্রী ভেবে বসলো !
আমরা যখন ঘর দেখছিলাম তখন বাড়িয়ালা এসে বলল
-আপনাদের বিয়ে হয়েছে ক'বছর ?
বাড়িয়ালার কথা শুনে আমরা দুজনেই একটু চমকে উঠলাম ! আসলেই এই কথাটা আমরা কেউ ভাবি নাই যে এমন কিছু হতে পারে অথবা এমন প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হবে । দুজনেই একটু দৃষ্টি বিনিময় করলাম !
নুপুর বলল
-বেশি দিন না ! এই মাস ছয়েক !
বাড়িয়ালা হাসতে হাসতে বলল
-যাক ভাল ! ভাল ! এই সময়ই আসল জীবন !
বাসা মোটামুটি ঠিক করেই ফেললাম ! দুজন যখন রিক্সা করে বাসায় আসছিলা তখন দুজনেই একটু সংকুচিত ছিলাম । একটু অস্বস্থিও লাগছিল !
বারবার বাড়িওয়ালা কথাটা কানে বাজতেছিল ।
আপনাদের বিয়ে হয়েছে ক'বছর ?
আপনাদের বিয়ে হয়েছে ক'বছর ?
-কি ব্যাপার চুপ কেন ?
আমি বাস্তবে ফিরে এলাম ।
-কই না তো !
নুপুর হেসে বলল
-বাড়িওয়ালার কথা ভাবছেন ?
-হুম !
তারপর আবার নিরবতা ! যেন কারো কিছু বলার নাই ! রিক্সা চলছে তো চলছেই । আমি হঠাৎ বললাম
-আমি আসলে ...।
-আপনি আসলে .... কি ?
-না মানে এই বাড়িওয়ালাকে মিথ্যা বলা কি ঠিক হচ্ছে ?
-নাহ ! একদমই ঠিক হচ্ছে না ।
-কি করা যায় ?
-বাড়িওয়ালার কথাটা সত্যি করে ফেলেন !
-মানে ?
আমি কেবল একরাশ বিশ্ময় নিয়ে তাকালাম নুপুরের দিকে ! নুপুর তখন দিকে তাকিয়ে আছে ! আমি জানি ওর মুখে একটা লজ্জার ভাব চলে এসেছে ।
আমার মনটা হঠাৎ করেই ভাল হয়ে গেল । রিক্সাওয়ালা কে বললাম
রিক্সা ঘোরাতে ।
নুপুর আমার কথা শুনে একটু অবাক হলেও কিছু বলল না !
কেবল হাসতে লাগল মিসমিস করে !
রিক্সা চলছে মগবাজার কাজী অফিসের দিকে !
ফুর-ফুরে বাতাস হচ্ছে ! সেই বাতাসে নুপুরের চুপ উড়ছে ! আমি সেই চুলের দুলুনী দেখতে লাগলাম ।
আজকে আমার মার্কেট পার্টনার আমার লাইফ পার্টনার হতে চলেছে !
আহা !! আহা !!
YOU ARE READING
বুক পকেটের গল্পরা (ভলিউম ০৩)
Short Storyব্লগে গল্প লিখছি সেই ২০১১ সাল থেকে । অনেক গল্প সেখানে জমা হয়ে গেছে । সেই গল্প গুলোই আস্তে আস্তে এখানে এনে জমা করা হচ্ছে । দুইটা ভলিউম এর আগে প্রকাশ হয়েছে ।