এক
-মা এতো আওয়াজ কিসের বাইরে !
বিয়ের বাসায় যদি কোন কারনে হট্টগোল শুরু হয় তাহলে সব থেকে বেশি চিন্তিত হন মেয়ে পক্ষের লোকজন । বিশেষ করে মেয়ের বাবা আর মা ।
বর পক্ষ চলে এসেছে বেশ কিছুটা সময় আগেই । সুভীর উপর থেকেই বর পক্ষের আসাটা দেখেছে । অদ্ভুদ একটা আনন্দ অনুভব হচ্ছিল সুভীর মনে । কিন্তু বাইরে থেকে এমন হট্টগোলের আওয়াজ কানে আসাতে সুভীর মন টাতে কেমন জানি হয়ে গেল । আবার আগের মত কোন সমস্যা হল না তো ?
-মা কি হল বাইরে ?
সুভীর প্রশ্ন শুনে সায়রা বেগমের নিজের মুখ শুকিয়ে গেল । তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-ও কিছু না ! তুই চিন্তা করিস না । আমি দেখছি !
এই বলে তিনি সুভীকে রেখে উঠে গেলেন । এতোক্ষন পুরো রুম জুড়ে হাসি হই হুল্লোড় চলছিল তা হঠাৎ করেই একেবারে থেমে গেছে । সুভি পাশে তাকিয়ে দেখে ওর সব বান্ধবী গুলোর মুখও কেমন শুকিয়ে গেছে !
একে একে সবাই বাইরে বের হয়ে গেল কি হয়েছে দেখার জন্য ।
সুভি একা হয়ে গেল । ঠিক এরকমই একাই সেদিন হয়ে গিয়েছিল । সেবারও এরকম গন্ডোগোল থেকে শুরু একে একে ঘরের সবাই তাকে ছেড়ে গিয়েছিল । তারপর একটা সময় সব চুপ হয়ে এল আস্তে আস্তে । বর যাত্রী চলে গেল ।
সুভির কেন যেন মনে যে আজকেও তেমন কিছু একটা হতে যাচ্ছে !
কিন্তু ছেলেটাকে তো ও সব কিছু বলেছিল । যদি তখনই ও না করে দিত তাহলে তো আর ঘটনা এতো দুর এগুতো না !
তাহলে সমস্যা কোথায় হল ?
কেন হল ?
সুভি আর কিছু ভাবতে পারছিলো না ! কি করবে এখানেই অপেক্ষা করবে নাকি বাইরে গিয়ে দেখবে কি হয়েছে এরম দোটানা চিন্তার মধ্যে যখন সুভি পরে আছে ঠিক সেই সময়ে সুভির মোবাইল টা বেজে উঠলো । স্ক্রিনে নাম্বার দেখে সুভির মনে কেবল একটা কথাই মনে হল যে এই সময়ে এর ফোন কেন ?
দুই
চৌধুরী সাহেদুল্লাহ একটু চিৎকার করলেই তার প্রেসার বেড়ে যায় ! আর প্রেসার বাড়লেই তার বাঁ কাঁধে ব্যাথা করতে শুরু করে । তখন বেশ কিছুটা সময় তাকে শুয়ে থাকতে হয় । কিন্তু এখন সাহেদুল্লাহর কোন প্রকার ব্যাথা অনুভব হচ্ছে না ! তিনি একটু যেন বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন !
তিনি আবারও চিৎকার করে বললেন
-আপনারা এক টা মিথ্যুক ! চিটার ..... বিয়ে হওয়া মেয়ের আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন .. আপনাদের ...... আপনাদের......
বর যাত্রীর কয়েকজন এগিয়ে এসে সাহেদুল্লাহ কে থামানোর চেষ্টা করলো কিন্তু তিনি কিছুতেই থামতে নারাজ !
-আপনি আপনাদের নামে মামলা করবো .....
-আঙ্কেল থামুন !
আরও অনেকেই থামানোর চেষ্টা করলো কিন্তু তিনি কিছুতেই কারো কথা শুনবেন না !
মেয়ে পক্ষের লোকও কম যায় না । তারাও সমানে এই কথা অস্বীকার করে যাচ্ছে । মেয়ের আগে কোন ভাবেই বিয়ে হয়েছে এটা তারা মেনে নিতে প্রস্তুত না ! তাদের এক কথা বিয়ে করতে যদি ইচ্ছাই না থাকে তাহলে এতো তাল-বাহনা কেন ?
কেউ কেউ আবার বলে উঠলো যৌতুকের টাকা নেওয়ার জন্য বরপক্ষ এমনটা করছে ।
বিয়ের বাড়িতে চরম হইচই !
এতো কিছু ভিতর আবার নতুন কথা কানে এল যে মেয়ে নাকি ঘরের ভিতর পাওয়া যাচ্ছে না ! সে সারা বাড়িতে কোথাও নেই ।
এই কথা বরপক্ষের কানে যেতেই আবার নতুন করে হইচই বেঁধে গেল ! বরের বাবা সাহেদুল্লাহ আবারও চিৎকার চেঁচামিচি শুরু করে দিল ! চিৎকার করে বলল
-আল্লাহ বাঁচিয়েছে আমার ছেলের জীবন । এই মেয়ের আরও কত কি করেছে কে জানে !
বরের বাবার এই কথা শুনে মেয়েপক্ষ থেকে মেয়ের বাবা চিৎকার করে এগিয়ে এলেন
-মুখ সামলে কথা বলবেন !
-কি সামলাবো না ? আপনার মেয়েকে সামলাম আগে !
-আচ্ছা সামলাবো ! বিদেয় হোন এখন !
-হ্যা । যাচ্ছি যাচ্ছি ! আমাদের কোন সখ নেই এখানে বসে থাকার ! এই সাফায়েত চল ! আর এক মুহর্ত নয় !
সাফায়েত হচ্ছে বরের নাম !
হঠাৎ ভীড়ের ভেতর থেকে একজন এগিয়ে এসে সাহেদুল্লাহের কানে কানে কি যেন বলল !
তখনই সাহেদুল্লাহর মুখের ভাব বদলে গেল !
তিনি বেশ জোরেই বলল
-সব জায়গায় দেখেছিস ?
-জি !
-মোবাইলে ফোন দিয়েছিস ?
-জি বন্ধ !
এতোক্ষন তিনি যে ব্যাথা অনুভব করছিলেন না সেটা যেন হঠাৎ করেই অনুভব করতে লাগলেন ! একটা চেয়ার পেতে বসে পড়লেন !
এদিকে মেয়ের বাবা লতিফ আহমেদ বলল
-কি ব্যাপার যাচ্ছেন না কেন আমার বাসা থেকে ?
-কোথায় যাবো ? আগে বলেন আমার ছেলেকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন ?
লতিফ আহমেদ যেন আকাশ থেকে পরলেন !
-কি বলতে চান আপনি ?
-আমি বলতে চাই আমার ছেলেকে ফেরৎ দিন । যখনই দেখেছেন আমরা চলে যাচ্ছি তখনই আমার ছেলেকে কোথায় ধরে নিয়ে গিয়েছেন । আমি কিন্তু পুলিশ ডাকবো !
-ডাকুন ! দেখুন গিয়ে কার না কার সাথে পালিয়ে গেছে । নিজের ছেলেকে সামলান আগে !
এভাবে কথার পর কথা চলতেই থাকলো ! কিন্তু সমাধান পাওয়া গেল না !
কেউ বলছে আগে ছেলেকে ফেরৎ দিন কেউ আবার বলছে আপনাদের ছেলে আপনি জানেন ! আমরা কিছু জানি না !
তিন
লতিফ সাহেবের বাড়ি থেকে ৫ কিলোমিটার দুরে একটা সাদা মারুতি গাড়ি চলছে । গাড়িটা আস্তে আস্তে দুরে সরে যাচ্ছে প্রতি মুহুর্তে ।
সাফায়েত শান্ত মুখে গাড়ি চালাচ্ছে । তবে বাইরে থেকে মুখ টা শান্ত দেখালেও মনের ভেতরে সে দারিন উত্তেজিত ! তার চোখ বারবার পাশে বসা মেয়েটার দিকে চলে যাচ্ছে । পাশে বসা মেয়েটির দিকে বার বার ফিরে তাকাচ্ছে । কিছু বলবে বলবে করেও বলছে না ।
সাফায়েতের কিছু বলার আগেই পাশে বসা মেয়েটি বলল
-সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালান ! নয়তো ধাক্কা লাগবে !
-ধাক্কা লাগার কি আর বাকি আছে ?
-মানে ?
মেয়েটি চট করে সাফায়েতের দিকে ফিরে তাকালো । কয়েক মুহুর্তের জন্য সাফায়েত যেন অন্য কোথায় চলে গেল । এতোটা কোমল মুখ যে এর আগে কোন দিন দেখেছে কি না সে বলতে পারবে না । তার উপর বউয়ের সাজে মেয়েটাকে যেন আরও বেশি সুন্দর লাগছে !
মেয়েটি আবার বলল
-আপনি প্লিজ সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালান ! আমাকে পরেও দেখতে পারবেন ! আমি তো চলে যাচ্ছি না !
এই কথা শুনেই সাফায়েত গাড়ি থামালো ! রাস্তাটা যে খুব বেশি ব্যস্ত সেই কথা বলা যাবে না । মাঝে মাঝে কয়েকটা গাড়ি হুস হাস করে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে । তাছাড়া মোটামুটি শান্তই !
শাফায়েত বলল
-না তোমাকে এখন এভাবে না দেখলে সারা জীবন আফসোস থেকে যাবে কেন তোমাকে ভাল করে দেখি নি !
-কেন ? আমি কি হারিয়ে যাচ্ছি ?
-হারিয়েই তো যাচ্ছিলে ?
-আমার দোষে ?
সাফায়েত কিছুটা চুপ করে থাকলো ! তারপর বলল
-না আসলে তোমার দোষ না !
-আপনি আপনার বাবাকে কেন বলেন নি কথা টা ?
-বললে বাবা হয়তো আসতোই না ! তখন ?
-তখনই কি ভাল হত না ? এরকম সমস্যা হত না !
সাফায়েত বলল
-তাহলে কি তুমি এখন আমার এই গাড়ির ভিতর থাকতে এখন ?
সুভি কোন না কথা বলে চুপ করে রইলো ।
সবার জীবনে যেমন কিছু কিছু না কিছু দুর্ঘটনা থাকে ঠিক তেমনি ভাবে সুভির জীবনেও আছে । যখন সে কলেজে পড়ে তখন তার বাবা তাকে প্রায় জোর করেই এক প্রবাসী ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিল । তবে ভাগ্য ভাল যে বিয়েটা হয়েছিল টেলিফোনে ।
বিয়ের কদিন পরেই লতিফ আহমেদ জানতে পারেন যে ছেলে যে যোগ্যতা বলে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল আসলে সে অন্য কিছু করে । বুয়েট থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার শুনে লতিফ আহমেদ রাজি হয়েছিল । আমেরিকায় নাকি পিএইচি করতে গেছে । অথচ পরে প্রকাশ পায় যে ছেলে ডিভি পেয়ে আমেরিকায় গিয়েছিল । এখন সেখানে ট্যাক্সি চালায় !
ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল কিন্তু এই একটা কারনই সুভির জন্য কাল হয়ে দাড়ায় ! সব কিছু ঠিক থাকার পরেও বিয়ে ভেঙ্গে যায় ! গতবার একেবারে বিয়ের দিন বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল । আর আজকেও তেমন কিছু হতে যাচ্ছিল কিন্তু তখনই সুভির মোবাইলে সাফায়েতের ফোন আসে !
সুভি প্রথমে একটু অবাক হলেও ফোন টা রিসিভ করে !
-হ্যালো !
-জি বলুন !
-বিয়ে টা মনে হয় ভেঙ্গে যাচ্ছে !
সুভি বলল
-আপনি আপনার বাবাকে বলেন নি ! আমি তো আপনাকে সত্য কথাটা বলেছিলাম !
কিছুক্ষন নিরবতা ! তারপর সাফায়েত বলল
-আসলে আমি বাবাকে বলতে পারি নি ! বললে .....।
সুভি জানে কেন বলতে পারে নি । বললে হয়তো বিয়েটা আরও আগেই ভেঙ্গে যেত !
সুভি শান্ত কন্ঠে বলল
-তাহলে আর কি । ভাল থাকবেন !
-আরে শুনো শুনো !
-কি !
-আমি একা একা ভাল থাকার জন্য তোমাকে এখন ফোন করি নি ! আমি সত্যি তোমাকে বিয়ে করতে চাই !
-তাহলে আপনার বাবাকে বোঝান !
-বাবার এখন মাথা গরম । কিছুতেই ঠান্ডা হবে না ! একটা কাজ কি করতে পারবে ?
-কি কাজ ! তুমি কি এখন তোমাদের বাসায় পিছনে আসতে পারবে ?
সুভি যেন আকাশ থেকে পড়লো !
YOU ARE READING
বুক পকেটের গল্পরা (ভলিউম ০৩)
Short Storyব্লগে গল্প লিখছি সেই ২০১১ সাল থেকে । অনেক গল্প সেখানে জমা হয়ে গেছে । সেই গল্প গুলোই আস্তে আস্তে এখানে এনে জমা করা হচ্ছে । দুইটা ভলিউম এর আগে প্রকাশ হয়েছে ।