গাঢ় অন্ধকারকে চিরে এগিয়ে চলছে পূর্বাশা পরিবহনের হেড লাইট । ঠিক সামনের সিটটাতে বসেছি, তাই সব কিছু পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি ! প্রথম প্রথম একটু ভয় ভয় লাগছিল । এমন সামনের সিটে আর বসা হয় নি আগে ।
সামনের আসা কোন গাড়ি দেখলেই বুকের ভিতর একটা কাঁপন অনুভুব করছিলাম । বারবার মনে হচ্ছিল ঠিক মত পার হতে পারবে তো ?
পরে অবশ্য ঠিক হয়ে গেছে ! এখন একটু কম ভয় লাগছে । কিন্তু মনের ভিতর অন্য একটা অস্থিরতা রয়েই গেছে ।
সকাল বেলা যখন বড় খালা ফোন দিয়ে জানালো যে নাদিয়ার বিয়ে ঠিক হয় গেছে কেন জানি একটু অস্থিরই মনে হল ! তারপর খালাকে যখন বললাম যে নাদিয়া রাজি ?
খালা বলল
-হুম ! ও তো এমন কিছু বলল না । মানাও করলো না ! আর ছেলেও তো খারাপ না !
-তাই বলে এতো জলদি ! ওর এখনও পড়াশুনাও শেষ হয় নি !
-আর বলিস না ! আমাদেরও ইচ্ছা ছিল না । কিন্তু পাত্র পক্ষে বলল যে ওরা কেবল কাবিন করে রাখতে চায় । পড়াশুনা শেষে, পরে উঠিয়ে নিবে !
আমি আর কোন কথা বলতে পারলাম না !
বারবার মনে হচ্ছিল নাদিয়া রাজি ?
আসলেই রাজি ?
নিশ্চিত হওয়ার জন্য নাদিয়াকে ফোন দিলাম !
-কি রে কি শুনছি ?
-কি শুনছেন ?
-তুই নাকি বিয়েতে রাজি ?
আমার এই কথার কোন চট করে কোন জবাব দিলো না ও ! আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম !
-কি রে কথা বলছিস না কেন ? রাজি তুই ?
-বাবা রাজি !
-তোর বাবা তো আর বিয়ে করবে না । তুই বিয়ে করবি ! তুই রাজি কি না বল ?
-না রাজি হওয়ার মত তো কিছু নাই । দেখতে শুনতে ভাল । ভাল চাকরি করে । সমস্যা কি ? একদিন তো বিয়ে করতেই হবে সুতরাং করেই ফেলি ! আর সব চেয়ে বড় কথা ....
এই বলে নাদিয়া একটু চুপ করে গেল !
আমি বললাম
-কি সব চেয়ে বড় কথা ?
-সব চেয়ে বড় কথা সে আমার কথায় মূল্য দেয় ! আমি যা বলব সে শুনবে !
বুঝলাম শেষ কথাটা নাদিয়া আমাকে উদ্দশ্য করেই বলল । আমি বললাম
-বাহ ! এরই ভিতর এতো কিছু জেনে গেছিস ?
-হুম ! কয়েক দিন থেকেই তো কথা হচ্ছে !
এতো কিছু হয়ে গেল আর আমি কিছু জানতেই পারলাম না ! যে মেয়ে দিনে কম করে হলেও আমার কাছে ১০ বার ফোন দিতো । ফোন দিয়ে নানান প্যাচাল পাড়তো সেই মেয়ে নিজের বিয়ের কথাটা আমার কাছ থেকে চেপে গেল !
মেজাজ টা বড় খারাপ হল ! ফোন কেটে দিলাম ! ভাবলাম জাহান্নামে যাক সব ! ওর বিয়ে হয়ে গেলে আমার কি ?
অফিসের কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম । কিন্তু কিছুতেই কোন কাজে মন বসাতে পারলাম না । মনে হচ্ছিল কি যেন আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ।
এটো দিনের পরিচিত একজন হুট করেই অপরিচিত হয়ে যাবে । রাতের বেলায় টিকিট কেটে গাড়িতে উঠলাম ! কেন উঠলাম জানি না !
বাস চলছে দুর্বার গতিতে । সাই সাই করে আশে পাশের ঘরবাড়ি গাছপালা ফেলে এগিয়ে চলছে । আমি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সামনে ! কোন দিকে তাকিয়ে আছি বা কোন কিছু দেখছি কি না জানি না তবুও তাকিয়ে আছি ! এই বাসের ভিতর ঘুম আসছে না ! আমি পুরানো দিন গুলোর কথা ভাবছি !
বংশের ভিতর সব চেয়ে বড় ছেলে হওয়াতে আমার সব কিছুর উপর একটা আলাদা প্রভাব ছিল ! আমার চাচা খালা সবার কাছেই আমি ছিলাম প্রিয়পাত্র । বিশেষ করে বড় খালার কাছে । আর পাশাপাশি বাড়ি হাওয়ার কারনে বড় খালার বাড়িতে যাওয়া আসাও ছিল বেশি !
আমার যখন ১০ বছর বয়স তখন নাদিয়ার ছয় !
তখন থেকেই আমার খেলার সাথী সে। তবে ওর সাথে খেলা কম করতাম আর ওকে মারতাম বেশি ! আমার হাতে মার খেতে খেতে ওর অবস্থা খারাপ হয়ে যেত ।
মা বাবার কাছে বিচার দিয়েও খুব একটা লাভ হত না !
এমন কি আমি যখন ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছি তখনও নাদিয়া আমার হাতে মার খেয়েছে। মাঝে মাঝে চুলের মুঠি ধের ঝাকি দিতাম ! ও "মাগো" বলে চিৎকার দিতো । আর আমি দাঁত বের করে হাসতাম !
আমার কোন কথার অবাধ্য হলেই হয় ওর খবর ছিল । এতো মার খাওয়ার পরেও নাদিয়া ঠিকই আমার পিছন পিছন ঘোরাঘুরি করতো ! কেন করতো কেন জানে ?
বাসায় ভাল কিছু রান্না হলেই বাটিতে করে নিয়ে আসতো আমার জন্য !
একদিনের কথা মনে আছে । ভুনা চিংড়ি মাছ আমার খুব পছন্দের । একদিন দুপুরে ভাত খেতেছি দেখি নাদিয়া বাটিতে কিছু নিয়ে এসেছে । আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
-নেন আপনার জন্য মা পাঠিয়েছে ।
আমি বাটি নিয়ে দেখি চিংড়ি মাছ ভুনা । আমি মুখে দিয়েই আবার থু দিয়ে ফেলে দিলাম ! বললাম
-ইয়াক ! এতো লবন কেন ? নিশ্চই তোদের বাড়ির বুয়া রেধেছে ?
নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে । আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকেই দৌড় দিয়ে রুম ছেড়ে চলে গেল । আমি কিছু বুঝতে পারলাম না ।
পরে জানতে পারলাম যে চিংড়ি টা নাদিয়া নিজে রেঁধেছিল ! আমাদের বাসা থেকে এসে নাকি ও নিজের হাতে সব তরকারি নর্দমায় ফেলে দিয়েছে !
শেষে আমি নিজের গিয়ে ওকে শান্ত করি !
বাস থেকে যখন নামলাম তখন প্রায় ছয়টা বেজে গেছে ! খালাদের বাড়ির সামনে এসে দেখি সারা বাড়ি জেগে আছে । দুই দিন পরেই বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে হচ্ছে । এখন কি ঘুমালে চলে ?
আমার নিজের বাসায় যাওয়ার কথা আগে কিন্তু আমি নাদিয়াদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম ! আমি বাড়ির ভিতর ঢুকতেই দেখলাম খালু বের হয়ে এল ! আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন ! কোনার ঘর থেকে দেখলাম নাদিয়াও বের হয়ে এল ! কাছে এল না কেবল দুর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ! আমার কেন জানি মনে হল ওর মুখে সুক্ষ একটা হাসির রেখা !
খালু আমার দিকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন । বললেন
-যাক তুই এসেছিস আমার ঝামেলা একটু কমবে ! এতো কিছু কি আমি আর তোর বাপ মিলে সামলাতে পারি ?
আমি খালুর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
-খালু আপনি ওদের মানা করে দেন !
-মানে কি ? কাদের মানা করে দিবো ?
খালু মনে হয় আমার কথা ঠিক মত বুঝতে পারলো না । আমি বললাম
-নাদিয়াকে আমি বিয়ে করবো ! আপনি ওদের মানা করে দেন !
খালু সাহেব খানিকটা অবাক বিশ্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন । ঠিক যে বিশ্বাস করতে পারছে না । আবার আমার চেহারার গাম্ভীর্য দেখে ঠিক অবিশ্বাস করতে পারছে না ।
আমি বললাম
-আমি বাসায় যাচ্ছি ! আব্বাকে পাঠাচ্ছি !
আর কিছু না বলে ঘুরে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম । তখনও খালু সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে ।
বাসায় সব কিছু ম্যানেজ করতে খুব বেশি বেগ পেতে হল না । সব থেকে কাজ হল খালার ইচ্ছা । খালারও নাকি আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল কিন্তু আত্মীর ভেতরে আত্মীয় হবে এইজন্য তিনি কিছু বলেন নি । খালু সাহেবও অরাজি ছিল না ।কিন্তু বর পক্ষকে কি বলবে তাই নিয়ে চিন্তত ছিল !
ঠিক দুই দিনের মাথায় নাদিয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল ! সব কিছু ঠিক ছিল কেবল বরের জায়গার আমার নাম বসে গেছে ! বাসর রাতে যখন রুমে ঢুকলাম দেখি নাদিয়ে ইয়া বড় এক ঘোমটা দিয়ে বসে আছে খাটের উপরে ! এই দিনে নাদিয়ার সাথে কথা হয় নি একদম । আমাকে কেন জানি একটু এড়িয়েই চলেছে সব সময় ! আমি ওর পাশে বসতে বসতে বললাম
-কি তুই ঐ বদ লোকের সাথে এতো কি ইটিশ পিটিস করেছিস ?
আমার কথায় নাদিয়া নিজেই ঘোমটা খুলে ফেলল !
-কি বললেন ? আমি ইটিশ পিটিস করেছি ?
-তা না হলে তুই এতো কিছু জানলি কিভাবে ?
-আপনাকে কেন বলবো ?
-কেন বলবো মানে ?
আমি এই বলে ওর চুলের মুঠি ধরতে গেলাম তখনই একটা অবাক করা ঘটনা ঘটলো !
নাদিয়া আমার হাত চেপে ধরে বলল
-এই খবরদার কিন্তু ! আমি কিন্তু এখন আর সেই নাদিয়া নেই !
আমি আসলেই খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম । কি বলে এই মেয়ে ! মানে কি ? বললাম
-মানে ?
-মানে বুঝেন না ? আমি এখন আপনার কাজিন না ! আমি আপনার বউ ! এটা মনে রাখেন !
আমি কিছুক্ষন নাদিয়ার দিকে আসলেই তাকিয়ে রইলাম । এই কয় ঘন্টায় এই মেয়ের কত পরিবর্তন !
নাদিয়া বলল
-আর এখন থেকে আমাকে তুই করে বললেন না !
-কি বলতে হবে ? আপনি ?
-তুমি করে বলবা ? আমিও তোমাকে তুমি করে বলবো !
-থাপড়িয়া তোর দাঁত খুলে ফেলবো !
নাদিয়া আমার দিকে কেবল তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন ! একভাবেই তাকিয়ে রইলো ! আমি নিজের ভিতরেই একটা অস্বস্থি বোধ করলাম !
আমি তখনই ওর চেহারাটা ভাল করে দেখলাম ! লক্ষ্য করলাম নাদিয়াকে সুন্দর লাগছে । বেশ সুন্দর লাগছে । ও যে এতো সুন্দর আগে লক্ষ্য করি নি তো ! আমি আস্তে করে ওর হাত ধরতে গেলাম !
তারপর ..........
তারপর কি হল নাই শুনলেন । জামাই বউ বাসর রাতে কি করবে তা আপনাদের কেন বলবো ? ফুটেন ......
YOU ARE READING
বুক পকেটের গল্পরা (ভলিউম ০৩)
Short Storyব্লগে গল্প লিখছি সেই ২০১১ সাল থেকে । অনেক গল্প সেখানে জমা হয়ে গেছে । সেই গল্প গুলোই আস্তে আস্তে এখানে এনে জমা করা হচ্ছে । দুইটা ভলিউম এর আগে প্রকাশ হয়েছে ।