নীলুর ঘুমটা বেশ পাতলা । সামান্যতম শব্দেই ঘুম ভেঙ্গে যায় । রাতে ঘুমাতে গেলে কতবার যে সে চোখ মেলে তাকাবে তার কোন ঠিক নেই । আজকেও যখন রান্নাঘর থেকে টুকটাক আওয়াজ আসছিল নীলুর ঘুম ভেঙ্গে গেল । যদিও ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই । বাসাটা তার কাছে নতুন হলেও নীলু জানে রান্না ঘরে কে আওয়াজ করছে । প্রতিদিনই এরকম আওয়াজ হয় । সাফায়েতের রাত জেগে থাকার অভ্যাস আছে । রাত বেশি হয়ে গেলে যখন খিদে লাগে তখনই সাফায়েত রান্না ঘরে যায় । কোন কোন দিন ফ্রিজে রাখা বাসি খাবার গরম করে অথবা নিজেই কিছু ভেজে নেয় । নীলু প্রতিদিন ভাবে রান্না ঘরে গিয়ে সে কিছুটা সাহায্য করে কিন্তু কেমন জানি সংকোচ হয় । নতুন বিয়ে হলেও স্বামী স্ত্রীর ভেতরে আসলে যে রকম সম্পর্ক থাকার কথা নীলু আর সাফায়েতের ভিতর সেরকম কিছু এখনও তৈরি হয় নি । দুইজন পাশাপাশি ঠিকই থাকে কিন্তু একে অপরকে খুব একটা চিনে কি না কে জানে । নীলুর অবশ্য ইচ্ছে করে মানুষ টাকে চিনতে কিন্তু সাফায়েত একটা অদ্ভুদ দেওয়াল সৃষ্টি করে রেখেছে নিজের সামনে । অন্য রকম এক গাম্ভীর্যের দেওয়াল । নীলু কিছুতেই সেই দেওয়াল ভেদ করতে পারে না । হঠাৎই রান্না ঘর থেকে কিছু একটা পরার আওয়াজ এল । মাঝরাতে আওয়াজটা বেশ ভালই শোনা গেল । এবার মনে হয় রুম ছেড়ে ওঠা যায় । নীলু এতোক্ষন যেন এই সুযোগটার জন্যই অপেক্ষা করছিল । নীলু রান্না ঘরে গিয়ে দেখলো সাফায়েত উপুর হয়ে বসে কিছু একটা গোছানোর চেষ্টা করতে । সারা রান্না ঘরে ডিমের হলুদ সাদা অংশ পরে একাকার । -সরুন । আমি পরিস্কার করছি । সাফায়েত পিছন ফিরে তাকিয়ে বলল -আরে তোমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম দেখছি । -আপনি উঠুন । -আরে কোন সমস্যা নেই । আমি পারবো । -আপনি পারবেন বুঝলাম । এখন উঠুন তো । সাফায়েত কিছুটা সময় কি যেন ভাবলো । তারপর রান্না ঘর থেকে উঠে গেল বেসিনের দিকে । নীলু বলল -অন্য কিছু কি বানিয়ে দেব ? -না দরকার নেই । আর কিছু না বলে সাফায়েত আবারও টিভির সামনে গিয়ে বসলো । প্রতি রাতে ও কেবল এই কাজটাই করে । ঘন্টার পর ঘন্টা টিভির সামনে বসে থাকে । সামনে রাখা টি-টেবিলের উপর একটা ল্যাপটপ খোলা থাকে । কিছু করে কি না ও নিজেই বলতে পারবে না । -এই নিন । টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলেও সাফায়েত যেন অন্য কিছু ভাবছিল । নীলুর কথা শুনে ফিরে তাকালো । এক প্লেট ডিমে ভাজা পাউরুটি । প্রায় দিন রাতেই সাফায়েত এটাই বানিয়ে খায় । আজকে নীলু বানিয়ে এনেছে । বাটিটা সাফায়েতের হাতে দিয়েও নীলু চলে গেল না । পাশেই দাড়িয়ে থাকলো । নীলুকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলল -কিছু বলবে ? -না । না বললেও কেন জানি নীলুর যেতে ইচ্ছে করছে না । মনে হচ্ছে একটু দাড়িয়ে থেকে সাফায়েতের খাওয়া দেখতে । কদিন থেকেই কেন জানি এই অদ্ভুদ ইচ্ছে টা ওর প্রায়ই জেগে ওঠেছে । বিশেষ করে ও যখন খারার খায় কিংবা অফিসের জন্য তৈরি হয় নীলুর সেটা দেখতে অদ্ভুদ ভাল লাগে । কোন ব্যাখ্যা হয়তো নেই তবুও নীলুর ভাল লাগে । -বসলে চাইলে বস । নীলু বসল । কিছুটা সময় কেটে গেল চুপচাপ । সাফায়েত ততক্ষনে প্লেট থেকে একটা করে পাউরুটি নিয়ে খেতে শুরু করেছে । ওর চোখ টিভির দিকে । নীলুর খিল খিল করে হাসির শব্দে খানিকটা যেন চমকে যেন নীলুর দিকে ফিরে তাকালো । অবাক হয়ে বলল -হাসছো কেন ? -আপনাকে দেখে ? -আমাকে ? আমি কি করলাম ? -না, মানে টিভিতে হাসির মুভি হচ্ছে আপনি দেখছে কিন্তু আপনার মন অন্য দিকে । আমি ঐ মুভি সিন দেখে হাসলাম । আপনি দেখলে আপনিও হাসতেন । -আমি টিভি দেখছি । -হুম দেখছেন । ছাতা দেখছেন । সাফায়েত কি বলবে ঠিক বুঝলো না । আসলেই সে টিভির দিকে তাকিয়ে ছিল ঠিকই তবে সে কিছু দেখছিলো না । সাফায়েত বলল -ছাতা ? -হুম । আমব্রেলা । এই বলে নীলু আবার খিল খিল করে হেসে উঠলো । টিভির শব্দ নামানো । সেটা ছাপিয়ে নীলুর হাসির আওয়াজ পুরো ঘরে জুড়ে বয়ে এক অদ্ভুদ ধ্বনিতে বাজতে লাগলো । সাফায়েত কেবল অবাক হয়ে নীলুর হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো । এতো প্রানবন্ত হাসি সাফায়েত এর আগে কোন দিন দেখেছে কি না সে বলতে পারবে না । এই মধ্যরাতে সাফায়েতের কেন জানি নীলুর এই হাসিটা মোটেই খারাপ লাগছিলো না । #দুই সাফায়েতের একটা ব্যাপার নীলুর মোটেই ভাল লাগে না । প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় সে প্রতিদিন চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতর ঢোকে । কেন বাবা, কলিংবেল টা কেন লাগানো হয়েছে ? একবার কলিংবেলে চাপ দিলে কি হয় ? নীলুর কত দিনের শখ সাফায়েত এসে কলিং বেল চাপ দিবে, দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিবে । তারপর হাতের ব্যাগটা নিজ হাতে নিয়ে নিবে । কিন্তু না । মানুষ টা যদি একটু বুঝে ? একদিন নীলু সকালবেলা সাফায়েতের চাবির গোছা লুকিয়ে রাখলো । যাতে করে সে চাবি নিয়ে যেতে না পারে । কিন্তু ঠিকই অফিস যাওয়ার সময় চাবির জন্য এদিক ওদিন খুজতে লাগলো । নীলু ভুলে গিয়েছিল যে ঐ চাবির গোছার ভিতর ওর অফিসের চাবিও আছে । শেষে খোজার ভান করে ও নিজেই চাবি খুজে দিল । -ওখানে চাবি গেলো কিভাবে ? নীলু কিছু হয় নি কিংবা সে কিছুই জানে না এমন ভাব করে বলল -আপনিই হয়তো গিয়েছিলেন ওখানে ? -আমি ? আমি চাবি নিয়ে বারান্দায় কেন যাবো ? -তাহলে আমি লুকিয়ে রেখেছি ? -আমি কি তাই বলেছি ? -তাহলে ? চাবি কিভাবে গেল আমি কিভাবে জানবো । -আচ্ছা ঠিক আছে । হয়তো আমারই ভুল হয়েছে । সাফায়েত আর কথা বাড়ায় নি । চাবি হাতে নিয়ে সোজা ঘর থেকে বের হয়ে গেছে । তবে আজকে নীলু আর কোন ভুল করে নি । চাবির গোছা থেকে কেবল ঘরের চাবিটা খুলে রেখেছে । অবশ্য নীলুর একটু একটু ভয় করছিল যে সাফায়েত হয়তো ধরে ফেলবে যে সেখানে একটা চাবি নেই । কিন্তু তেমন কিছুই হয় নি । সাফায়েত টেরই পায় নি যে সেখানে একটা চাবি নেই । আজকে নীলুর মন টা তাই আজ একটু ফুরফুরে । সময় যাচ্ছে সাথে সাথে তার মনে আনন্দের সীমা টা যেন একটু একটু করে বাড়ছে । কিভাবে দরজা খুলবে কিভাবে কাধের ব্যাগ নিবে এই নিয়ে বেশ কয়েক বার সে ট্রায়ালও দিয়ে ফেলল । ঠিক সন্ধ্যার আগেই কলিংবেল বেজে উঠলো । নীলু যেন একটু উড়ে চলে গেল দরজা খুলতে । কিন্তু দরজা খুলে দেখে, বাড়ির দারোয়ান । নীলুর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল । -কি চাই ? -আফা তালাওয়ালা আইছে ? -কেন ? -আপনে না বলছিলেন গেটের একটা চাবি বানাইবেন । ভুইলা গেলেন ? -ও । না ভুলি নি । -চাবি কি বানাইতে দিমু ? -দাও । কয় টাকা লাগবে ? -১০০ টাকা । নীলুর উৎকন্ঠা আস্তে আস্তে বাড়তেই লাগলো । কিন্তু অন্যান্য দিনের তুলানায় আজকে সাফায়েত যেন একটু বেশিই দেরি করছে । আর থাকতে না পেরে নীলু সাফায়েতকে ফোন দিয়ে ফেলল । -আপনি কোথায় ? -এই তো বাসায় আসছি । -আজকে এতো দেরি কেন হচ্ছে ? -দেরি কোথায় ? আমি তো প্রতিদিন এই সময়েই আসি । -ও তাই ? আচ্ছা । -কিছু লাগবে তোমার ? নীলুর কি মনে হল বলল -বেলি ফুল পেলে নিয়ে আসবেন । বলেই মনে হল কি বলল এটা । বেলি ফুল ।। সাফায়েত কি মনে করবে কে জানে ? ঠিক আধাঘন্টা পরে আবারও কলিং বেল বেজে উঠলো । দুূরু দুরু বুক নিয়ে নীলু এগিয়ে গেল দরজা খুলতে । দরজার ঠিক ওপাশে সাফায়েত দাড়িয়ে । এতো দিনের প্রতিক্ষীত একটা দিন । ঠিক এমনই যেন চেয়েছিল । নীলু একয়া হাসার চেষ্টা করলো কিন্তু ঠিক মত হাসি বের হল না । কেমন একটা অপ্রস্তুত হয়ে দাড়িয়ে রইলো সাফায়েতের সামনে । সাফায়েত দাড়িয়ে আছে এক হাতে চাবির গোছা অন্য হাতে একটা বেলি ফুলের মালা নিয়ে । নীলুর দিকে তাকিয়ে বলল -গেটের চাবিটা এখানে নেই । পরে গেল নাকি । আশ্চর্য । -জি না । -তাহলে ? -আমি খুলে রেখেছি । সাফায়েত খানিকটা অবাক হয়ে বলল -তুমি খুলে রেখেছ ? কেন ? -জানি না । নীলু কেন এমন করে সব স্বীকার করে ফেলল কে জানে । ও নিজেই ঠিক মত বলতে পারবে না । সাফায়েতের হাত থেকে প্রথমে বেলি ফুলের মালাটা নিল । তারপর কাধের ব্যাগ টা খুলে নিল নিজের হাত দিয়ে । আজকে নীলু এতো সাহস কোথা থেকে এল নীলু কিছুই জানে না । বারবার মনে হল যে আজকে নয়তো আর কোন দিনই নয় । সাফায়েত কেবল অবাক হয়ে কিছুটা সময় নীলুর দিকে তাকিয়ে রইলো । -ভেতরে আসবেন না ? সাফায়েত কোন কথা না বলে ভেতরে ঢুকে পড়লো । সোজা শোবার ঘরের দিকে হাটা দিল । নীলুর একবার মনে পেছন থেকে ডাক দেয় ওকে । ডেকে বলে এই জন্য চাবিটা সরিয়ে রেখেছি যাতে আপনার কাধের ব্যাগ টা নিতে পারি । বাধরুম থেকে সাফায়েত যখন ফ্রেস হয়ে বের হল নীলুর খুলে নেওয়া চাবি টা সাফায়েতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল -এই নিন আপনার চাবি । -ওটার আর দরকার নেই । -কেন ? -আসলে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তো চাবি দিয়ে দরজা খুলতে খুলতে । তখন দরজার ওপাশে কেউ থাকতো না আমার জন্য । ভুলেই গিয়েছিলাম যে এখন আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে থাকে । ওটা রেখে দাও তোমার কাছেই । নীলু কি বলবে খুজে পেল না । কেবল লক্ষ্য করলো অসম্ভব ভাল লাগার একটা অনুভুতি ওকে ওকে পেয়ে বসেছে । খুব ইচ্ছে করছে সাফায়েতকে জড়িয়ে ধরতে । কিন্তু এটা করা যাবে না । ও কি ভেবে বসবে কে জানে । -খাবেন না ? -হ্যা চল । খাওয়া যাক । খাওয়ার জন্য যখনই সাফায়েত উঠে দাড়িয়েছে তখনই নীলু আরেকটা কাজ করে বসলো । বলা নেই কওয়া নেই সাফায়েত কে জড়িয়ে ধরলো । কয়েক মুহুর্ত আসলেই নীলু যেন কোন কিছু হুস ছিল না । কি ভেবে সাফায়েত কে জড়িয়ে ধরলো ও বলতে পারবে না । যখন আবার নিজের ভেতরে ফিরে এল তখন সাফায়েত কে ছেড়ে দিয়ে রান্না ঘরের দিকে দৌড় দিল । যাওয়া সময় কেবল একটা চিন্তাই ছিল যে একটু পরে যখন খাবার টেবিলে ওকে সাফায়েতের সামনে দাড়াতে হবে তখন ও কিভাবে ওর দিকে তাকাবে । #তিন সাফায়েত তার বড় চাচার বাসায় মানুষ হয়েছে । বারার মৃত্যুর পরে যখন তার মা অন্য একজনের সাথে বিয়ে বসে গেল তখন সাফায়েতের ইচ্ছে হয় নি মায়ের সাথে থাকার । তখন মায়ের উপর খুব অভিমান হলেও এখন সে বুঝতে পারে তখন মায়ের সিদ্ধান্তটা তখন হয়তো ভুল ছিল না । তার মা তো তাকে সাথে নিতেই চেয়েছিল কিন্তু সেই তো যায় নি । প্রথম প্রথম বড় চাচার বাসায় থাকতে তার একটু অস্বস্তিই লাগতো । মনে হত চাচা চাচি আর তাদের মেয়ে মিলি তাকে মনে হয় একদম পছন্দ করে না। কিন্তু আস্তে আস্তে সেটা কেটে গিয়েছিল । বিশেষ করে বড় চাচি তাকে তার নিজের ছেলের মত করেই ভালবেসে ছিল । তবে সংসারে তার চাচাতো বোন মিলির সাথে তার সম্পর্ক ছিল সব থেকে কাছের । যদিও মিলি ওর থেকে বছর খানেকের বড় ছিল তবুও ওদের সম্পর্ক টা বড় ছোটের হিসাবে আটকে থাকে নি । কতবার দুজন মিলে কত গল্প করেছে কত খেলা করেছে কত মারামারি করেছে সেটার হিসাব নেই । এভাবে অনেকটা বছর থাকার পর এক সময় পার হয়ে সাফায়েতের মনে হল সে হয়তো মিলিকে ভালোবাসে । কিন্তু বয়সে খানিকটা ছোট হওয়ার কারনে সেটা কোন দিন সাফায়েত তাকে বলতে পারে নি । ভার্সিটিতে ওঠার দ্বিতীয় বছরেই মিলির বিয়ে হয়ে যায় । ওর পছন্দের ছেলের সাথে । মিলি কোন দিন টেরই পায় নি সাফায়েত তাকে পছন্দ করতো । কোন দিন সে সেই চোখে দেখতো না । মিলি টের না পেলেও আর একজন ঠিক পেয়েছিল । সাফায়েতের বড় চাচী আফিয়া বানু, মিলির মা । বিয়ের আগের দিনও সাফায়েতকে কাছে ডেকে বলল -তুই মিলির বিয়েতে খুশি না কেন ? সাফায়েত কিছু একটা লুকাতে চাইলেও লুকাতে পারলো না । চাচির দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকালো । আফিয়া বানু বলল -আমার দিকে তাকা । অন্য দিকে তাকিয়ে আছিস কেন ? -না চাচি এমনি । -তুই মিলিকে ভালবাসিস এটা ওকে কেন বলিস নি । এখনও সময় আছে । ওকে বল । দেখ ও কি বলে । সাফায়েত কিছু সময় কিছু বলতে পারলো না । কি বলবে সেটাও ঠিক মত বুঝতে পারলো না । -বল । এখনও সময় আছে । -না চাচি । ও কোন দিন আমাকে তেমন করে দেখে নি । আমি ওর সামনে এই কথা বলতে পারবো না । আর ওর নিজের পছন্দ করা ছেলে । আফিয়া বানু কিছুটা সময় সাফায়েতের দিকে তাকিয়ে বলল -দেখ, আজকাল কার ছেলেরা কেমন আমি খুব ভাল করেই জানি । আমার মেয়ে কার কাছে সব থেকে ভাল থাকবে এটা আমি খুব ভাল করে জানি । সাফায়েত কিছু না বলে চুপ করে রইলো । আফিয়া বানু বলল -আর কটা দিন অপেক্ষা করলে হয়তো আমরা নিজেরাই তোদের বিয়ে দিতাম । কিন্ত মিলি যে এটো বড় কাজ করে ফেলবে আমরা বুঝতে পারি নি । -চাচি আপনি কেন মন খারাপ করছেন ? আফিয়া বানু সাফায়েত কে জাড়িয়ে ধরে বললেন -আমার বাচ্চা টা মন খারাপ করে আছে । আমি মন খারাপ করবো না । সাফায়েত কি বলবে বুঝতে পারলো না । -মন খারাপ করিস না রে বাবা । তোর জন্য আরও ভাল কেউ নিশ্চই অপেক্ষা করছে । দেখে নিস । তার পরেও অনেক টা দিন কেটে গেছে । চাকরি পাওয়ার পরেও সাফায়েত বিয়ে করছিল না তখন আফিয়া বানু সাফায়েতের বিয়ের জন্য পিড়াপিড়া শুরু করে দেয় । তিনি কোন কথাই শুনবেন না । প্রতিদিন সাফায়েতকে ফোন করে বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাথে । কোন বলা নেই কওয়া নেই গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে এক প্রকার জোর করে ধরে নিয়ে মেয়ে দেখানোর জন্য । তার নাকি কোন আত্মীয়ের মেয়ে । সাফায়েতের কোন কিছুতেই ইচ্ছে ছিল না কিন্তু চাচীর উপরে কোন কথা বলল না । বলতে পারলো না । এভাবে চলল মেয়ে দেখানোর ব্যাপার । মাসে মাসে চাচি ঢাকায় আসে । মেয়ে দেখাতে নিয়ে যায় । সাফায়াতের মাঝে মাঝে মনে হয় সেই মুন্সিগঞ্জ বসে সে ঢাকার এতো মেয়ের খোজ কোথায় পায় ? কিন্তু কিছু বলে না । চাচির সাথে মেয়ে দেখতে যায় । বাসায় এসে বলে দেয় তার মেয়ে পছন্দ হয় নি । মেয়ের খুঁত বের করে দেখায় । চাচী মুখ বেজার করে আবার গ্রামের বাসায় চলে যায় । আর পরের মাসে নতুন মেয়ের খোজ নিয়ে হাজির হয় ঢাকায় । এভাবেই চলছিল দিন । কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো অন্যখানে । আগের দিন মেয়ে দেখে এসেছিল তবে তখনও মানা করে নি । চাচি কে বলেছে একটু ভেবে বলবে । প্রথম দিনেই মানা করলে চাচি একটু চিৎকার চেঁচামিচ করে । একটু ভেবে বললে কিছু বলতে পারে না । অফিসের লাঞ্চ আওয়ারে পিয়ন এসে খবর দিল একটা মেয়ে নাকি তার সাথে দেখা করতে চেয়েছে । একটু পরে যখন মেয়েটা ঘরের ভেতর ঢুকলো সাফায়াতের বিশ্ময়ের সীমা রইলো না । সামনে জড়সড় হয়ে দাড়ানো মেয়েটা গত কালকের দেখতে যাওয়া মেয়েটা । সাফায়েতের মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না মেয়েটা এখানে কি করছে । এখানে তো তার থাকার কথা না মোটেও । তাহলে ?বিশ্ময় কাটতে একটু সময় লাগলো । -বসুন । -মেয়েটি জড়সড় হয়ে বসলো ওর সামনে । কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন বলতে পারছে না । সাফায়েত কি বলবে সেটাও ঠিকমত বুঝতে পারছে না । এরকম পরিস্থিতির জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না । মেয়েটা যে ওর কাছে আসতে পারে এমন কোন ধারনা তার মাথায় ছিল না । এমন কি মেয়েটার নাম পর্যন্ত সাফায়েতের মনে নেই । গতকাল মেয়েটার নাম শুনেছে কিন্তু ঠিক মত মনে নেই । -আমি নীলু । -জি, আমি জানি । যদিও মিথ্যা কথা । সাফায়েতের মেয়েটার নাম মনে ছিল না । সাফায়েত বলল -আপনি এখানে ? মেয়েটা মাথা নিচ করেই বলল -আপনি কি খুব অবাক হয়েছেন ? -জি একটু অবাক হয়েছি বটে । অবাক হওয়ারই তো কথা । তাই না ? -হুম । -কোন জরুরী কাজ ছিল ? -ঠিক জরুরী না আবার ....... মেয়েটার কন্ঠে একটু যেন দ্বিধা কাজ করছে । বলবে কি বলবে না এই সিদ্ধান্তে নিতে মেয়েটার ভাবতে হচ্ছে । সাফায়েত বলল -আপনি বলুন প্লিজ । কোন সমস্যা নেই । নীলু তবুও কথা বলতে আরও কিছুটা সময় নিল । তারপর মাথা নীচে করেই বলল -আমার বাবা আপনার ব্যাপার খুব বেশি আশা করে ফেলেছে । -আশা ? সাফায়েতের বুঝতে একটু সময় লাগলো মেয়েটা আসলে কোন আশার কথা বলছে । নীলু বলল -আসলে যখন আপনাদের পক্ষ থেকে কোন প্রকার দাবী দাওয়ার কথা আসবে না এমন কথা শুনে বাবা কেন যেন খুব বেশি ভেবে বসে আছেন যে এবার বুঝি আমাকে বিদেয় করতে পারবেন । -বিদায় কেন বলছেন ? -চারটা অবিবাহিত মেয়ে থাকলে আপনার মনেও এরকম কথা আসতো । তাই নির্লজ্জের মত আপনার কাছে এসেছি । কেন এসেছি আমি জানি না । তবে যদি মানা করে দেন তাহলে আজকেই মানা করে দেবেন প্লিজ । দেরি হলে বাবা মাঝে মাঝে খুব অস্থির হয়ে ওঠে । ভেবে বসেন যে বিয়েটা হয়েই যাচ্ছে । তারপর যখন না হয় তখন খুব বেশি পাগলামি করে । একটানা কথা বলে নীলু একটু দম নিলো । যেন হাঁপিয়ে উঠেছে । সাফায়েত আবারও খুজে পেল না কি বলবে । নীলু আরও কিছুটা সময় বসে থেকে চলে গেল । বাসায় এসে সাফায়েত বিয়ের জন্য হ্যা বলে দিল । কেন বলল সেটা সে নিজেই বলতে পারবে না । দেখতে দেখতে কদিনের ভিতর বিয়ের কথা বার্তা পাকা । বিয়ে হতেও খুব বেশি সময় লাগলো না । কিন্তু বিয়ের সাফায়েত আর নীলুর সম্পর্ক স্বাভাবিক হল না । এতোদিন ধরে সাফায়েত মিলি ছাড়া অন্য কাউকে নিজের মত করে ভাবে নি । নীলুও সাফায়েত নিরবতা দেখে কোন কথা বলে নি । নিজের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে । জীবন চলতে লাগলো । কিন্তু গত কয়েকদিনের ঘটনায় অনেক টাই বদলে গেছে ওদের সম্পর্ক টা । #চার সকালের ঘুমটা সাফায়েতের সব সময় প্রিয় । ছুটির দিনগুলোতে সে বিছানায় ঘুমিয়ে কাটাতেই পছন্দ করে । আগে খাওয়া দাওয়ার একটা ব্যাপার ছিল যেটা নিয়ে একটু চিন্তিত থাকতে হত, বুয়ার রান্না কেন যেন সাফায়েত ঠিক মত শান্তি মতে খেতে পারে না । বাইরে যেতে হত খাওয়ার জন্য । কিন্তু এখন নীলুর সাথে বিয়ে হওয়ার পরে সেটাও করতে হয় না । মেয়েটার রান্নার হাত চমৎকার । এই কদিনের ভেতরেই কেমন করে সংসার টা নিজের করে গুছিয়ে নিয়েছে । আফিয়া বানু সাফায়েতকে বলেছিল মিলির থেকে ভাল কেউ তার জন্য অপেক্ষা করছে । সাফায়েতের মাঝে মাঝে মনে যে মিলি আসলে কি আসলেই জীবন টা অন্য রকম হতে পারতো । কে জানে । সাফায়েত আরও একবার পাশ ফিরে শুলো । তখন দেখলো নীলু দরজার ধারে দাড়িয়ে আছে । ওর দিকে তাকিয়ে । চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল । সাফায়েতের মনে হল মেয়েটা এই জায়গায় বেশ কিছু টা সময় ধরেই দাড়িয়ে আছে । চোখটা ভাল করে মেলে নীলু দিকে তাকাতেই সাফায়েত একটা ছোট্ট ধাক্কার মত খেল । নীলু একটু আগে সম্ভবত গোছল করেছে । ওর চুল এখনও ভেজা । একটা পবিত্র আভা ওর সারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে । ওর দিক দেখে সাফায়েত চোখ সরাতে পারলো না । কেবল তাকিয়েই রইলো । আর মেয়েটা আজকে হলুড রংয়ের একটা শাড়ি পরেছে । সাথে চোখে কাজলও দিয়েছে । হলুদ পরীর মত লাগছে । -নীলু । -জি । -কিছু বলবা ? -না মানে । নাস্তা করবেন না ? -হুম । নাস্তা রেডি ? -জি । বেলা হয়ে গেছে । কিছু খেয়ে আবার না হয় ঘুমাবেন । -না । আর ঘুমাচ্ছি না । উঠছি । নীলু তবুও দাড়িয়ে রইলো । সাফায়েত বাধরুমের দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে থামলো । তারপর নীলুর দিকে তাকিয়ে বলল -তোমাকে সুন্দর লাগছে । হলুদ শাড়িতে খুব সুন্দর মানিয়েছে । এইটুকু বলে বাধরুমে ঢুকে পড়লো । নীলুর রান্না ঘরে রুটি গরম করতে করতে লক্ষ্য করলো ওর চোখ দিয়ে পানি পরছে । চোখের কাজল লেপ্টে একাকার হয়ে যাচ্ছে । কেন যে পানি পড়ছে সেটা ও নিজে বুঝতে পারছে না । তবে ওর মনে আশ্চার্য একটা ভাললাগা কাজ করছে । নিরবে নাস্তা খাওয়ার সময়ে নীলু সব সময় সাফায়েতের সামেন বসে থাকে । যদিও ওর সামনে প্লেটে থাকে তবুও নীলু কিছু মুখে দেয় না ঠিক মত । সাফায়েত কয়েকবার বলেছে খাচ্ছো না কেন ? এই তো খাচ্ছি বলে প্লেটের দিকে মনযোগ দেয় কিন্তু ঐ পর্যন্তই । সাফায়েতের মনে হয়েছে ওকে খাইয়ে এবং খেতে দেখে নীলু সম্ভবত ভাললাগে । কেন লাগে কে জানে ? আজকে টেবিলে বসার পর থেকেই নীলুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে নীলু যেন কিছু একটা বলতে চায় । কিন্তু বলতে পারছে না । সাফায়েত বলল -কিছু বলবে তুমি ? -না । কিছু না । -বল । সমস্যা নেই । নীলু বলতে আরও কিছু সময় নিল । তারপর বলল -মানে বিকেলে কি আপনি কোথাও যাবেন ? -কেন ? -না মানে । আজকে ১৩ই ফেব্রুয়ারি । বসন্তের প্রথম দিন । -ও তাই নাকি । আচ্ছা । -আপনি কি আমাকে চারুকলায় নিয়ে যাবেন ? -বিকেলে ? ওখানে তো অনেক মানুষ থাকবে । অনেক ভিড় হবে । নীলু মুখটা মুহুর্তেই মলিন হয়ে গেল যেন । মুখ মলিন করে বলল -আচ্ছা । ঠিক আছে । নীলু আবার নিজের প্লেটের দিকে মনযোগ দিলো । সাফায়েত বলল -ওখানে না যাই । এমনি অন্য কোথাও যাওয়া যায় । লাইক রিক্সা করে এদিক ওদিক যাওয়া যায় । যেমন করে নীলুর মুখটা কালো হয়ে উঠেছিল ঠিক তেমন করে আবার মুখটা উজ্জল হয়ে ওঠলো । সাফায়েত বলল -চলবে ? -আচ্ছা । সাফায়েত কেবল অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো নীলুর কাজল দেওয়া চোখটা কেমন টলচম করছে । যেন যে কোন সময় ওর চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসবে । মেয়েটার চোখে নিশ্চিত কোন সমস্যা আছে । এতো ঘন ঘন পানি আসে কেন । সাফায়েট বলল -কিন্ত একটা সমস্যা । -কি সমস্যা ? -আসলে বসন্তের বাইরে বের হওয়ার জন্য মনে হয় পাঞ্জাবী পরতে হয় । আমার আসলে সেরকম কোন পাঞ্জাবী কেনা হয় নি কোন দিন । অন্য শার্ট কিংবা গেঞ্জি পরলে চলবে ? মানে তুমি তো হলুদ শাড়ি পরবে । -আপনি চিন্তা করবেন না । আপনার জন্য আমি পাঞ্জাবী কিনে রেখেছি । সাফায়েত বেশ অবাক হয়ে বলল -আমার জন্য । -হুম । ------------- আজকের বিকেল টা নীলুর জন্য অন্য রকম । আজকের আকাশ টাও যেন একটু বেশি নীল । মেঘ মুক্ত আকাশের নীলটা যেন আরও বেশি নীল মনে হচ্ছে । দিনটা সাফায়েতের জন্যও অন্য রকম । অন্য রকম আনন্দের । সেটা মুখ দিয়ে প্রকাশ করা না গেলেও মন দিয়ে অনুভব করতে পারছে ও । রিক্সা চলতে আস্তে । চারিপাশ দিয়ে মানুষের ভীড় । নীলুর এসব কিছু খেয়ালে আসছে না । কেবল খেয়াল হচ্ছে তার পাশে সাফায়েত বসে আছে । একটু আগে সাহস করে তার হাতটা ধরা রয়েছে হাতে । #463
YOU ARE READING
বুক পকেটের গল্পরা (ভলিউম ০৩)
Short Storyব্লগে গল্প লিখছি সেই ২০১১ সাল থেকে । অনেক গল্প সেখানে জমা হয়ে গেছে । সেই গল্প গুলোই আস্তে আস্তে এখানে এনে জমা করা হচ্ছে । দুইটা ভলিউম এর আগে প্রকাশ হয়েছে ।