-পানি খাবেন ?
আমি আজহার সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখি লোকটা শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । এমন একটা ভাব যেন এই রকম দু'চারটা কথা সে প্রতি নিয়তই শুনে থাকে । অবশ্য পুলিশের চাকরীতে এই রকম হওয়াটা স্বাভাবিক । আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আজহার সাহেব আমার দিকে পানির গ্লাসটি এগিয়ে দিল । একটু ইতস্তঃ করে আমি পানি ভর্তি গ্লাসটি তুলে নিলাম বাঁ হাতে ।
হঠাৎই কেন জানি মনে হল আমার খুব পানির পিপাসা পেয়েছে । এই পানি টুকু না খেলে হয়তো তৃষ্ণায় আমি মারা যাবো । এক চুমুকেই পুরো টুকু পানি খেয়ে নিলাম ।
-আর কিছু খাবেন ?
-জি ?
পুলিশ এতো ভাল ব্যবহার করছে !! বিশ্বাসই হচ্ছে না ঠিক । হয়তো একটু পরেই আমার কপালে খারাবী আছে ! ছাগল জবাই করার আগে যেমন তাকে আদর যত্ন করা হয় হয়তো আমার বেলাতেও সেই রকম কিছু হতে যাচ্ছে ।
-খাবেন আর কিছু ?
ইন্সেপেক্টর আজহার আবার বলল কথা টা । আমি কাঁপা কন্ঠে বললাম
-জি না । কিছু খাবো না ।
আজহার সাহেবের মুখে একটু যেন হাসির রেখা দেখতে পেলাম । টেবিলের উপরে রাখা একটা বেল চাপ দিলেন । কয়েক সেকেন্ড পরেই একজন সেন্ট্রি টাইপের লোক রুমের ভিতর ঢুকলো ।
-দুইকাপ চা নিয়ে এসো ।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি দুধ চা খান নাকি র চা ?
-দুধ চা ।
আজহার সাহেব সেন্ট্রি টাইপের লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল
-একটা দুধ চা ।
লোকটা চলে গেল ।
--------
আমি জানতাম নীলা আমার কাছ থেকে এমন কথা শুনে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাবে । কিছুক্ষন তাকিয়েই রইলো আমার দিকে । চোখের সামনেই ওর মুখের ভঙ্গি বদলে যেতে দেখলাম । এতোক্ষন যেখানে নীলার চোখে অদ্ভুদ একটা বিষন্নতা ছিল সেখানে একটা ক্রোধের চিহ্ন উদয় হল ।
-আমি সত্যি বলছি বিয়ে করবি আমাকে ?
-দেখ সুমন আমার সাথে হয়তো অনেক খারাপ কিছু হয়ে গেছে কিন্তু আমাকে করুনা করার অধিকার আমি কাউকে দেই নি । তোকেও না ।
-তুই এভাবে কেন নিচ্ছিস ?
-তো কিভাবে নিবো ? আমার বিয়ে হচ্ছে না । বাবা মা চিন্তায় অস্থির । আমার হবু বর আমাকে ফেলে চলে গেছে । যাক মেয়েটাকে বিয়ে করে পরোপকার করা যাক । তাই না ?
-নীলু তুই ভুল বুঝছিস !
-দেখ ! আমার আর এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না । তুই রিকোয়েস্ট করেছিলি বলে এখানে এসেছিলাম । কিন্তু এই কথা বলবি জানলে কোন দিন আসতাম না ।
এই টুকু বলেই নীলা উঠে দাড়াল । তারপর হনহন করে হেটে চলে গেল । একটা বারের জন্যও পিছন ফিরে তাকালো না ।
নীলার সাথে ঐ দুর্ঘটনাটা ঘটার পর থেকেই নীলা কেমন যেন হয়ে গেছে । কারো সাথে ঠিক মত কথা বলে না কারো সাথে দেখাও করে না । আর অবাক করা বিষয় ওর পরিচিত মানুষ গুলোও যেন নীলা কে একটু এড়িয়ে চলতে শুরু করে।
কি আজব মানুষ গুলোর আচরন ! নীলাকে সেই কাজটার জন্যই শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে যেটার জন্য ও কোন ভাবেই দায়ী না । এতো কিছুর পরেও হয়তো অবস্থা অতটা খারাপ হত না যদি না মিতুল ভাই এই কাজটা না করতো ।
আমি ঐ দিন ওদের কাছেই ছিলাম । নীলা তখন সবে মাত্র হাসপাতাল থেকে ফিরেছে । হাসপাতালের দিন গুলোতে অনেকেই নীলাকে দেখতে এসেছে । কিন্তু মিতুল ভাই একবারের জন্যও আসে নাই । একদিন নীলা নিজেই আমাকে ফোন করে বলল
-তুই কোথায় রে ?
-এই তো ! কেন ?
-মিতুলের খোজ নিয়ে দিতে পারবি ?
-পারবো । কেন ?
-না তুই শুধু খোজ নিবি ও কাল বিকেলে কোথায় থাকে । আর আমাকে ওর কাছে নিয়ে যাবি । পারবি না ?
-হুম ।
আমি অত কিছু বুঝতে পারি নি । পরদিন বিকেল বেলা নীলাকে মিতুল ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেলাম । আমি ভেবেছিলাম ওরা হয়তো কথা বলবে । আমি নীলাকে মিতুল ভাইয়ের কাছে দিয়ে যখন চলে আসবে তখন নীলা বলল
-দাড়া । আমার কাজ এখনই শেষ হয়ে যাবে ।
মিতুল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি ওনার মুখটা কেমন হয়ে গেছি । উনি কিছু একটা বলতে গেলেন । কিন্তু নীলা ওনাকে মাঝ পথেই থামিয়ে দিল । তারপর আমাকে অবাক করে মিতুল ভাইয়ের গালে ঠাস করে একটা চড় মাড়লো ।
মানে কি ? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না । তারপর আমার দিকে হন হন করে হেটে চলে এল ! আমাকে বলল
-চল ! আমার কাজ শেষ !
আমি অবাক হয়ে বললাম
-এসবের মানে কি ?
-কোন মানে নেই !
নীলা আর দাড়ালো না ! হাটতে লাগলো সামনের দিকে ! আমি একবার নীলার দিকে তাকাই আরেকবার মিতুল ভাইয়ের দিকে । মিতুল ভাই এখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে । নীলা যে ওনাকে চড় মাড়বে এটা উনি ভাবতেই পারে নি । আমি নিজেও ভাবতে পারি নি ।
-------
-নিন ! চা খান !
আজহার সাহেবের চায়ের কাপে গাঢ় খয়েরী রংয়ের পানীও দেখা যাচ্ছে । আমার কাছে কেন জানি চায়ে র রংটা একটু রক্তের মত । শিবলুর শরীরের রক্তের রংটা কি এমন ছিল ? কে জানে ? আমার সামনেই যখন ওর শরীরের রক্তটা ছড়িয়ে পরে মেঝেতে তখন রংটা খানিকটা এমনই তো মনে হচ্ছিল । হয় তো তখন আলো টিমটিমে আলোর জন্যই এমন মনে হয়েছিল ।
তাই নয় কি ?
ইন্সেপেক্টের কথায় আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম । দুধের পরিমান একটু বেশি হয়েছে । আর একটু কম হলে ভাল হত । তবে খেতে মন্দ লাগছে না ।
আজহার সাহেব বলল
-তারপর ? তারপর কি হল ?
-আমি শিবলুর ঠিকানা জানতাম ! বলতে গেলে নিজেই ওর খোজা বের করি ! একদিন ওর সাথে সামনা সামনি দেখা হয়ে গেল ! ওরা যেখানে বসে আড্ডা মারে সেখানে ।
-মানে উকু মিয়ার ক্যারাম ঘরের পেছনে ?
-জি ! ওখানেই ওদের আড্ডা খানা ! সন্ধ্যা হলেই ওখানে বসে বসে ওরা তাস খেলে, মদ গাজা খায় !
-হুম ! তারপর বলুন !
-আমি যেদিন শিবলুকে সরাসরি দেখি সেদিন আশ্চর্য ভাবে লক্ষ্য করতে থাকি যে আমার পুরো শরীর জুরে এক আশ্চার্য ক্রোধ অনুভব করছি । আমি সারা জীবন নির্ভেজাল টাইপের মানুষ । কখনও কারো গালে একটা চড় মেরেছি বলে মনে পড়ে না । কিন্তু শিবলুকে দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গেল । কিভাবে যে নিজেকে সেদিন নিয়ন্ত্রন করেছিলাম আমি নিজেই জানি না । বাসায় এসে কেবল একটা কথাই মনে হল যে আমি শিবলুকে খুন করবো । যে কোন মূল্যেই ওকে খুন করবো ।
আজহার সাহেব একটু অবাক চোখে আমার দিকে তাকালো !
আমি বললাম
-কি অবাক হচ্ছেন ?
-একটু কি হওয়ার কথা না ?
-জি ! অবশ্যই অবাক হওয়ার কথা । ছা পোষা টাইপের একজন মানুষ হঠাৎ করেই একজন কে কিভাবে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে পারে । আমি নিজেই খুব অবাক হয়ে গেছিলাম নিজের উপর ।
-হুম ! বোঝা যাচ্ছে নীলাকে আপনি অনেক ভালবাসেন ! তাই না ?
-হয়তো !
-------
নীলা আমার সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দিল ! আমাকে ফোন করে না । আমি ফোন করলে ফোন ধরে না । মেসেজ পাঠালে উত্তর দেয় না । আমি কিছু দিন বেশ অস্থিরতায় কাটাতে থাকি । এমনি একদিন নীলার বাবা আমাকে ডেকে পাঠায় । ওদের বাসায় গিয়ে হাজির হলে তিনি আমাকে ডেকে জানতে চান আমি নীলা যা বলেছি তা সত্য কি না ?
তার মানে আমি সত্যি সত্যি নীলাকে বিয়ে করতে চাই কি না ?
জানি না উনি কিভাবে জেনেছেন তবে মনে হচ্ছে নীলা নিজেই বলেছে । আর তো কোন ভাবে জানার কথা না !
আমি বললাম
-জি ।
-তোমার ফ্যামিলি ?
-আমার বাসায় কোন সমস্যা নাই । মা আছে । উনি গ্রামে থাকেন । আমি বিয়ে করেছি জেনে উনি খুশিই হবেন । আর নীলাকে তো অপছন্দ করার মত কোন কোন কারন নেই ।
-কিন্তু ..।
নীলার বাবা কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেল ! আমি বললাম
-আঙ্কেল । এটা কোন সমস্যা না । আপনি এটা নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না ।
দেখতে দেখতে নীলার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল । আমার আসলে ঐ দিন মনেই হয় নি যে আমাদের বাসায় কোন বিয়ে হচ্ছে । এমন কি বাসর রাতেও নীলা ছিল একদম চুপ । আমি ঘরে ঢুকে দেখি ও পাশে ফিরে শুয়ে আছে । একবার মনে হল ওকে ডাকি । কিন্তু ওকে ডাকি নি ! আমি জানি ও জেগেই ছিল । কেবল একটা চাদর টেনে দিলাম ওর গায়ের উপর ।
ছোট বেলা থেকেই অনেক কিছুই ভেবে রেখেছিলাম এই রাত টার জন্য কিন্তু তার কিছু মিল খুজে পেলাম না ।
সকাল বেলা উঠে সব আবার স্বভাবিক ! কেবল নীলা আমার বাসায় থাকছে এটাই নতুন । আমাকে সেই আগের মত তুই বলেই ডাকছে । আমি ওর সাথে টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করছি । কিন্তু আমরা যে স্বামী স্ত্রী এটা ঠিক মনে হচ্ছে না ।
-------
উকু মিয়ার দোকানের সামনেই একটা বাসা ভাড়া করলাম । পাঁচতলা যে সাদা বিল্ডিংটা । ঐ টা । একদম উপর তলায় । চিলে কোঠাও বলতে পারেন । কারনে একটা পাশ ফাঁকা ছিল । অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিলাম মাস খানেকের জন্য । বাসা থেকে ১০ টার দিকে বের হই । সোজা চলে আসি এখানে । সারা দিন লক্ষ্য রাখি । শিবলুদের আড্ডা খানায় কে কে আসে । কে যায় । আর ধীরে ধীরে নিজের কর্ম পন্থা ঠিক করি । আস্তে আস্তে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র এনে জোগার করতে শুরু করি । এক বারে আনলে মানুষ জন সন্দেহের চোখে দেখতে পারে তাই । আস্তে আস্তে আনতে থাকি ।
একবারে কথা গুলো বলেই আমি খানিকক্ষন চুপ করে থাকি ।
-তারপর ?
-তারপর একদিন মানে মাস খানেক আগে সুযোগটা আসে ।
-কি রকম ?
-কিছুদিন এলাকায় কিছু হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়েছিল মনে আছে ?
-জি ! এই তো ত্রিশ পয়ত্রিশ দিন আগে !
-সেটার প্রধান আসামী ছিল শিবলুর ও তার দলের লোক গুলো । ওরা সবাই তখন গা ঢাকা দেয় ! শিবলুও দেয় । কিন্তু দুতিনদিন পরেই ও চলে আছে ঐ আড্ডায় ! আমি ঐ দিন ছাদেই দাড়িয়ে ছিলাম ! দেখলাম টলতে টলতে শিবলু আড্ডা খানায় ঢুকছে ।
বাইরে প্রচুর ঠান্ডা ছিল । যত দুর মনে পড়ে সেদিন এলাকার তাপমাত্রা ছিল সব থেকে নিচে । আর রাত তখন প্রায় ১০ টা ! এতো রাতে পুরো রাস্তা এমনকি পুরা এলাকায় কেউ ছিল না । আর আড্ডা খানায় শিপলু ছাড়া আর কাউকে ঢুকতেও দেখি নি । আমার কাছে মনে হল এই সুযোগ । তবুও আম খুব বেশি তাড়াহুড়া করলাম না । নীলাকে ফোন করে বললাম আজকে বাসায় আসবো না । তারপর আরো দুই ঘন্টা অপেক্ষা করলাম ।
১২ বাজার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিয়ে নিচে নেমে এলাম । যখন আড্ডা খানার সমানে এবং পুরো এলাকা টা মনে হচ্ছিল যেন একটা মৃত্যুপুরি । দুরে কেবল একটা কুকুর দেখলাম দাড়িয়ে আছে ।
আমি দোকানের পিছনে ঢুকে পড়লাম । সম্ভাবনা ছিল আরও একজন লোক থাকলেও থাকতেও থাকতে পারে কীন্তু ভিতরে ঢুকে দেখি শিবলু ছাড়া আর কেউ নেই ! শিবলু উপুর হয়ে পড়ে আছে । মদ খেয়ে এমন মাতাল হয়ে আছে যে শীত টাও ঠিক মত অনুভব করতে পারছে না ।
আমি আবার থামলাম ।
তাকিয়ে দেখি ইন্সেপেক্টর আজহার আমার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে ।
------
আসলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের ভিতর মনে হয় আলাদা কিছু একটা আছে । যতই এক জন দুরে থাকার চেষ্টা করুক কিংবা নিজেকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করুক না কেন আস্তে আস্তে প্রিয় মানুষটার উপর এক ধরের মায়া জন্মে যায় । ভালবাসা জন্মে ! বিয়ের মাস খানেক যেতে না যেতেই আমি বেশ ভাল করেই বুঝতে পারছিলাম আস্তে আস্তে নীলার ভিতর স্ত্রী সুলোভ আচরন ধরা পরছিল । দিন গুলো খারাপ যাচ্ছিল না । বলতে গেলে আমরা সুখেই ছিলাম । অতীতের সব কিছু ভুলে নতুন কোন পথে আমরা হাটছিলাম ।
কিন্তু একটু চলতে গিয়েই হোঁচট খেতে হল ।
সেদিনের কথাটা স্পষ্ট মনে আছে ।
আমি আর নীলা বিকেল বেলা নিউমার্কেটে যাবো বলে বের হয়েছি । রেল গেইট ক্রসিং এ আটকা পরেছি তখন নীলা আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল
-চল এখান থেকে ।
আমি খানকিটা অবাক হয়ে বললাম
-কেন যাবি না ?
-না বাসায় চল ।
-কি হল ?
-তুই যাবি ! তুই যা ! আমি যাবো না !
YOU ARE READING
বুক পকেটের গল্পরা (ভলিউম ০৩)
Short Storyব্লগে গল্প লিখছি সেই ২০১১ সাল থেকে । অনেক গল্প সেখানে জমা হয়ে গেছে । সেই গল্প গুলোই আস্তে আস্তে এখানে এনে জমা করা হচ্ছে । দুইটা ভলিউম এর আগে প্রকাশ হয়েছে ।