বসুন্ধরা সিটিটা কেন জানি আমার সব সময়ই একটু অস্বস্তিকর লাগে । ঠিক মানিয়ে নিতে পারি না । এতো লোক, এতো হইচই ! আমার ঠিক ভাল লাগে না !
কিন্তু আজকে এতো কিছুর কিছুই যেন আমাকে স্পর্শ করছে না । এতো লোক জনের ভিতরেও আমার সব মনযোগ কেবল মাত্র সুমির দিকেই নিবদ্ধ !
ঐ তো দেখা যাচ্ছে । নিশ্চয়ই ওর কোন বান্ধবীর কিংবা বন্ধুর সাথে এসেছে !
গায়ে সাদা এপ্রোনটা এখনও জড়িয়েই আছে !
নিশ্চয়ই ক্লাস থেকে সরাসরি এসেছে !
আচ্ছা ও কি ডাক্তার হয়ে গেছে ?
আমি একটু পেছনের কথা হিসাব করার চেষ্টা করলাম । কয় বছর হবে !
তিন বছর ?
নাকি চার বছর ?
চার বছরই হবে । নাহ ! এখনও মনে হয় পুরোপুরি ডাক্তার হয় নাই ! আমি নিজের চোখ সরিয়ে নিতে চাইলাম । কিন্তু কেন জানি পারলাম না !
তাকিয়েই আছি সুমির দিকে !
ডাক্তার সুমি !
-সরি ! একটু লেট হয়ে গেল !
আমি বাস্তবে ফিরে এলাম ! অহীন সামনে দাড়িয়ে !
-বেশি দেরি করে ফেলেছি ?
আসলে আমার মুখটা একটু গম্ভীর ছিল বিধায় অহীন মনে করেছে আমি মনে হয় রাগ করেছি !
আমি মুখে হাসি আনার চেষ্টা করলাম ! বললাম
-আরে সমস্যা নাই ! আমিও মাত্রই এসেছি ! এদিক ওদিক দেখছিলাম !
অহীন আমার সামনের চেয়ারটা টেনে বসলো ! খানিকটা ইতস্তর করে বলল
-আপনি কিছু মনে করেন নি তো ?
-কোন ব্যাপারে ?
-এই তো আপনাকে এখানে দেখা করতে বললাম বলে ! আপনি ছুটিতে আছেন তবুও আপনাকে বিরক্ত করলাম !
অহীন আমার কলিগ । প্রায় এক বছর ধরে আমরা একসাথে কাজ করতেছি ! মেয়েটা ভাল ! দেখতে শুনতেও ভাল ! শুধু ভাল না বেশ ভাল ! অফিসের অনেকেই বলা বলি করে এই মেয়েটা নাকি আমাকে পছন্দ করে ! কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না ! আমি ঠিক জানি না ! কিন্তু গত কালকে অহীন যখন আমাকে ফোন করে দেখা করতে চাইলো একটু অবাক হলাম ! অফিসের বাইরে আমাদের দেখা করার মত এতো ঘনিষ্ঠতা এখনও হয় নাই ! যদিও অফিসে আমার কথা বার্তা হয় প্রায় !
আমি অহীনের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম । মেয়েটার মুখ কিছু সংকুচিত হয়ে আছে লজ্জায় !
তার উপর মেয়েটা বেশ জেগে গুজে এসেছে !
আমি বললাম
-আপনাকে দেখতে সুন্দর লাগছে ! আপনি এতো সুন্দর আগে তো লক্ষ্য করি নি ?
এই কথা বলাতে দেখলাম অহীনের মুখটা আরো বেশী লাল হয়ে গেল ! অন্য দিকে তাকিয়ে বলল
-কোন দিন তো বলেন নি ?
-আপনিও তো আমাকে কোন দিন এই ভাবে লাঞ্চ খাওয়ার দাওয়াত দেন নাই ?
-বাহ ! সব কিছু আমাকেই করতে হবে ?
আমি কথাটার জবাব দিতে গিয়েও দিলাম না ! চোখটা আবার চলে গেছে সুমির দিকে ! এখনও বন্ধুদের সাথে হাসাহাসিতে ব্যস্ত !
আচ্ছা ওর কি কোন বয়ফ্রেন্ড আছে ?
নিশ্চয়ই আছে ! কোন ডাক্তার বয়ফ্রেন্ড হবে হয়তো ! আমাকে তো তাই বলেছিল !
যখন সিলেটে ছিলাম তখনই সুমিকে চিনি । ও যখন কলেজে পড়ে তখন থেকেই ওর সাথে একটা মিষ্টি সম্পর্ক ছিল ! প্রায়ই দিনে আমি ভার্সিটির ক্লাস কামাই দিয়ে ওর কলেজের সামনে এসে দাড়িয়ে থাকতাম । ও ঠিক কয়েকটা ক্লাস মিস দিয়ে বের হয়ে আসতো ! তারপর ঘন্টা হিসাব করে রিক্সায় ঘোরাঘুরি ! কোন দিন কাছের কোন চা বাগানে সময় কাটানো !
সুমির ডাক্তার হওয়ার বড় ইচ্ছা ছিল ! স্বপ্ন দেখতো বড় একজন ডাক্তার হবে । এই জন্য সব কিছু সে বিষর্জন দিতে প্রস্তুত ! এই সব কিছুর ভিতর যে আমি নিজেও ছিলাম এটা বুঝতে পারি নি !
-কি ভাবছেন ?
-কিছু না ! কিছু খাবেন না ? লাঞ্চের সময় হয়ে যাচ্ছে ।
অহীন একট হেসে বলল
-আম তো বলেছি আমি খাওয়াবো ! টেনশন নিয়েন না !
-আরে আমি টেনশন নিচ্ছি না ! আর আমার কোন কাজও নাই । আমি সারাদিনই এখানে থাকতে পারবো !
-তাই ? থাকবেন আজকে আমার সাথে সারা টা দিন ? বসুন্ধরার পাশে যে লেইকটা আছে না ! ওটা আমার খুব পছন্দের জায়গা ! এখানের পরে ওখানে যাবেন ?
-হুম ! যাওয়া যায় !
আরো কথা হতে থাকে আমাদের ভিতর ! কিন্তু মনটা কেন জানি সুমির দিকেই পরে থাকে ! সুমির হাসির আওয়াজ কেন জানি কানে বাজতে থাকে ! তারমানে ও খুব সুখে আছে ?
আমি ?
আমিও ভাল আছি !
হুম ! আছিই তো ! কোন দুঃখ নাই ! ও যেমন আমাকে ছেড়ে থাকতে পেরেছে আমিও পারবো না কেন ? ওর কথা মনে করাই উচিৎ না !
অহীন বলল
-কি হল ? আপনার মন অন্য দিকে কেন ? আমার সাথে কথা বলতে ভাল লাগছে না !
-আরে কি বলেন ! আমার মন অন্য দিকে না !
-আচ্ছা বুঝেছি ! আসুন আগে লাঞ্চ করা যাক !
অহীন অর্ডার দিতে দিতে আমি এক ওয়াস রুম দিকে পা বাড়ালাম !
ওয়াস রুম থেকে বের হব এমন সময় সুমির সাথে দেখা হয়ে গেল ! সুমি ওয়াস রুমের ঠিক সামনেই ও দাড়িয়ে ছিল ! আমার কেন জানি মনে হল ও আমার জন্যই দাড়িয়ে ছিল ! প্রথম দেখা হলে একটা অবাক হওয়ার ভাব থাকে সুমি চেহারায় সেটা ছিল না । তারমানে আমি যেমন ওকে দেখেছি ঠিক সুমিও আমাকে দেখেছে আগেই !
আমি ওকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে চাইলাম !
-অপু ?
নামটা এখনও মনে আছে দেখছি !!
যেদিন সুমির মেডিক্যাল ভর্তির রেজাল্ট দিল সেদিন ওর আনন্দ দেখে কে ! একদম মেধা তালিকার প্রথম দিকে !
আমার সাথে ওর আর দুই দিন পরে দেখা হল ! এই কয় দিন ও একটুও সময় বের করতে পারে নাই ! আমরা রুপরংর টি স্টলের ভিতর হাটছিলাম ! সুমিকে একটু গম্ভীর মনে হচ্ছিল ! আমি হাটতে হাটতে বললাম
-আজিব তো ! মানুষ রেজাল্টের আগে টেনশন করে আর তুমি রেজাল্টের পরে টেনশন করতেছ ? কি ব্যাপার ? এতো গম্ভীর কেন ?
সুমি প্রথমে কিছু না বললেও একটা জায়গায় চুপ করে বসে রইলো কিছুক্ষন ! ওর মুখ দেখে মনে হল কিছু একটা যেন বলতে চায় আমাকে ! কিন্তু বলতে পরছে না ! আমি বললাম
-কিছু বলবা আমাকে ?
-হুম !
-বল !
-তুমি তো জানো আমি আমার ডাক্তারীর পেশার জন্য কতটা সিরিয়াস ?
-হুম ! জানি তো !
-আমার আর ডাক্তারীর মাঝে যেটাই আসুক না কেন আমি সব সময় ডাক্তারীকেই বেছে নিবো !
-হুম আমি জানি ! সমস্যা কি ?
-অপু ! তুমি এখন আমার পথের বাঁধা হয়ে আছো !
আমি প্রথমে কিছুক্ষন বুঝতে পারলাম না কি বলবো ! আমি ঠিক মত বুঝতেও পারলাম না যে আমি কিভাবে বাঁধা হয়ে দাড়াচ্ছি !
সুমি বলল
-দেখো, আমার মনে হয় তোমার সাথে আমার আর সম্পর্ক রাখা সম্ভব হবে ! একে তো পড়া লেখার চাপ তার উপর তুমি তো জানো, ডাক্তাদের সব সময় ডাক্তাদের সাথেই বিয়ে করা উচিৎ ! তা না হলে পরে অনেক সমস্যা হয় । আমি চাই না এমন সমস্যা হোক আমাদের ! তার চেয়ে ....
সুমি আরো কিছু বলছিল আমার কেন জানি আর কিছু কানে গেল না !
কেবল একটা কথাই ! আমি নাকি ওর পথে বাঁধা ! ওর লক্ষ্যের পথে বাঁধা !
তারপর সুমির সাথে আমার আর দেখা হয় নি ! মোবাইল থেকে ওর নাম্বার আর মেসেজ সব মুছে দিয়েছি ! নাম্বারও বদলে ফেলেছি ! সম্ভাব্য যার যার সাথে যোগাযোগ রাখলে ওর সাথে আবার দেখা হবার সম্ভাবনা ছিল এমন সবাইকেই বর্জন করেছি ! এই চার বছর ভালই ছিলাম ! একটা বারও ওর সাথে দেখা হয় নাই !
আমি তবুও না শোনার ভান করে চলে আসতে চাইলাম !
-অপু ?
-আপনি আমাকে কিছু বলছেন ?
সুমি কিছুক্ষন একটু অবাক হল ! আসলে ও ঠিক আমার কাছ থেকে এমন আচরন আশা করে নাই ! সুক্ষ একটা অপমান বোধের রেখা দেখতে পেলাম
-অপু ! আমি ?
-আপনি ?
সুমি কথা হারিয়ে ফেলল !
-কিছু বলবেন ? বললে তাড়াতাড়ি বলুন ! আমার গার্লফ্রেন্ড ওয়েট করছে !
-গার্লফ্রেন্ড ! তোমার গার্লফ্রেন্ড ?
-কেন ? কোন সমস্যা ?
সুমি এই কথার জবাব দিল না !
-দেখুন আমি ডাক্তার না হতে পারি তবে আমি কম টাকা ইনকাম করি না !
আমি ..........
আরো কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম ।
নিজেকে একটু সামলালাম ! কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সুমি কে দেখে কেন জানি আমার খুব রাগ হচ্ছে !
আমি বললাম
-আমি আসি !
-কি ব্যপার ? এতো গম্ভীর কেন ?
আমি হাসার চেষ্টা রকলাম ! কেন জানি রাগটা এখনও কমছে না ! কি করলে কমবে ?
আমি অহীনের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললাম
-আপনি আমাকে বিয়ে করবেন ?
বলেই মনে হল কি বললাম !!
কেন বললাম ?
আসলে হুস হারিয়ে ফেলেছি ! কি বলছি ঠিক বুঝতে পারছি না !
অহীন কেবল আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন ! মুখে একটা অবাক হওয়ার চিহ্ন !
-কি হল ?
-আপনি কি সিরিয়াস ?
-জি সিরিয়াস ! কররেন ? আজই ?
-আজই ?
-রাজি না থাকলেও বলতে পারেন কোন সস্যা নাই !
অহীন আমার দিকে সত্যি বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ! আমাকে যেন চিন্তে পারছে না বা বহুদিনের পরিচিত আমাকে যেন ঠিক চিনতে পারছে না ! আমি অহীনের দিকে তাকিয়ে বললাম
-কি রাজি না ?
-আমি কি বলেছি আমি রাজি না ?
-তাহলে চলুন লাঞ্চ করেই বিয়ে করে ফেলি ! তবে একটা শর্ত !
-কি !
-এই লাঞ্চের বিল কিন্তু আমি দিবো না ! এটা কিন্তু তোমাকেই দিতে হবে !
-আচ্ছা !
অহীন হেসে ফেলল ! বলল
-ঠিক আছে দিচ্ছি ! তারপর কাল থেকে সব কড়ায় গন্ডায় উসুল করবো কিন্তু !!
যখন রিক্সাটা কাজী অফিসের দিকে যাচ্ছিল আমি কেবল অনুভুব করলাম অহীন আমার হাত ধরে রেখেছে ! ওর চোখে একটা অজানা আনন্দ ! হঠাৎ করেই আমাকে পাওয়ার আনন্দ !
আমার বুকের ভিতরেও একটা অজানা ভাল লাগা ছিল ! এতো দিন কেবল মনে হয়েছে আমি সুমি ভালবাসি ! আজকে আমার সেই ভুল ভেঙ্গেছে ! আমি ওকে ভালবাসি না । আমার ভালবাসা পাওয়ার যোগ্যতা ওর নেই, আসলেই নেই !
YOU ARE READING
বুক পকেটের গল্পরা (ভলিউম ০৩)
Short Storyব্লগে গল্প লিখছি সেই ২০১১ সাল থেকে । অনেক গল্প সেখানে জমা হয়ে গেছে । সেই গল্প গুলোই আস্তে আস্তে এখানে এনে জমা করা হচ্ছে । দুইটা ভলিউম এর আগে প্রকাশ হয়েছে ।