বাসায় ঢুকতে গিয়েই থামতে হল ! পাশের বাসার সামনে তখন লাল রংয়ের গাড়িটা দাড়িয়ে !
গাড়ির বাঁ দিককার দরজার পাশে দাড়িয়ে ফয়সাল সাহেব মোবাইলে কার সাথে কথা বলছে, অন্য দিককার দরজা খুলে মেয়েটি বের হওয়ার চেষ্টা করছে ! এক হাতে স্টিক নিয়ে মেয়েটার দরজার দিয়ে বের হতে একটু বেগই পেতে হচ্ছে ! মেয়েটি একটু সাহায্য প্রয়োজন !
একবার ভাবলাম এগিয়ে যাই ! কিন্তু নিজেকে থামালাম ! সেটা আমার শোভা পায় না !
গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ এখনও পাওয়া যাচ্ছে তারমানে মাত্রই এল ওরা কোথা থেকে ! বেড়াতে গিয়েছিল মনে হয় !
মেয়েটা যখন গাড়ি থেকে অর্ধেক নিজেকে বের করে এনেছে তখনই আমার দিকে চোখ গেল মেয়েটার !
একটু হাসলো ! এমন একটা ভাব যেন সে ঠিক আছে ! কোন সমস্যা হচ্ছে না ! আমি আরও কিছুক্ষন দাড়িয়েই রইলাম !
মেয়েটা যখন গাড়ি থেকে বের হল ফায়সাল সাহেব তখন আবার গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসলেন ! তারপর গাড়ি ঘুড়িয়ে চলে গেলেন ! একটা বার ভাল ভাবে বিদায় নেওয়ার কথা ভাবলেনও না !
মেয়েটি গেট টার সামনে আরও কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইলো, যতক্ষন গাড়িটাকে দেখা যায় ততক্ষন সেদিকেই তাকিয়েই রইলো ! সেই চোখে অদ্ভুদ একটা বিষন্নতা !!
মেয়েটি কে আমি যে খুব ভাল করে চিনি বলতে পারবো না ! এমন কি মেয়েটার নামটাও আমি ভাল ভাবে জানি না ! কেবল ফেসবুকে মেয়েটার একটা একটা নাম আছে ! বিবর্ণ নীল !
আসলেই কেন জানি মাঝে মাঝে মেয়েটাকে ঐ নামটার সাথে বেশ মানানসই মনে হয় !
মেয়েটা আমার পাশের বাসায় থাকে । আরও ভাল করে বললে আমার ঘর থেকে মেয়েটার ফ্ল্যাট ভাল ভাবে দেখা যায় । বিশেষ করে ডাইনিং রুম আর মেয়েটার ঘরটা ! সাথে বারান্দা টা ! আমার বাসা তিন তলায় মেয়েটার বাসা দুতলায় !
মেয়েটা ওর মায়ের সাথে থাকে সম্ভবত ! কারনে কেবল আরেক মাঝ বয়সী মহিলাকেই দেখি ঐ ফ্ল্যাটে !
প্রথম মেয়েটাকে আমি লক্ষ্য করি কিছুদিন আগে । অবশ্য আমরা এখানে এসেছি খুব বেশিদিন হয় নি ! দিনটা ১৪ তারিখ ছিল ফেব্রুয়ারির ! বিশেষ একটা দিন ! সারাদিন নেট/পিসি নিয়ে ব্যস্ত থাকি রাতে ঘুমাতেও বেশ দেরি হয় ! যখন ঘুমাতে যাবো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় তিনটা বেজে গেছে ! আমি হাত পা একটু এদিক ওদিক নড়াতে নাড়াতে জানালের কাছে আসলাম হাওয়া খাওয়ার জন্য ! এসে নিচের দিকে তাকাতেই মেয়েটির দিকে চোখ গেল !
আমার জানালা দিয়ে মেয়েটির ডাইনিং রুমের খাবার টেবিলটা দেখা যায় বেশ ভাল ভাবেই ! দেখলাম সামনে একটা কেক নিয়ে মেয়েটি বসে আছে চুপ করে ! কারও আসার অপেক্ষা !
রাত তিনটা বাজে ?
এখনও কেক না কেটে কার জন্য অপেক্ষা করছে ?
মেয়েটির বিষন্ন মুখ দেখে আসলেই কেন জানি মন খারাপ হয়ে গেল !
আহা ! বেচারি কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করছে কে জানে ?
প্রিয় মানুষ টি নিশ্চই আজকে আসতে পারে নি ! এই জন্য মুখটি বিষন্ন !!
আমার আরও কিছু দেখার বাকি ছিল মনে হয় ! হঠাৎ টেলিফোন রিং হওয়ার আওয়াজ পেলাম । রাত বিধায় আওয়াজটা আমি পরিস্কার শুনতে পাচ্ছিলাম ! ল্যান্ড ফোনের আওয়াজ !
মেয়েটি উঠে গেল । তখনই লক্ষ্য করলাম আসলে মেয়েটি শারীরিক ভাবে একটু অপ্রতুল ! হাতের কাছে একটা স্টিলের স্টিক ছিল, মেয়েটা সেটা ধরে উঠে দাড়ালো ! তারপর আস্তে আস্তে খোড়াতে খোড়াতে হাটতে হাটতে অন্য ঘরে চলে গেল !
দৃশ্যটা দেখে আসলেই বুকের মাঝে হঠাৎই কেন জানি একটু কষ্ট হল ! বুঝতেই পারলাম না কেন ?
বারবার বিষন্ন মেয়েটার মুখ আর মেয়েটার খোড়া পায়ের দৃশ্যটা চোখে ভাসছিল ! একটা মেয়েকে চিনি না জানি না তার জন্য কষ্ট হতে লাগলো !
পরদিন ঘুম ভাঙ্গলো দুপুরের দিকে ! খাওয়া দাওয়া সেরেছি তখন প্রায় বিকেল ! বারান্দায় গিয়ে দেখি মেয়েটি ! আমার বারান্দা থেকে মেয়েটির বারান্দাটিও দেখা যায় পরিস্কার ! মেয়েটি বারান্দার মেঝেতে বসে আছে চুপ করে । সামনে একটা কলো রংয়ের ল্যাপ্টপ খোলা রয়েছে ! ল্যাপ্টপের পাশে একটা নীল রংয়ের কাপ রাখা ! তবে মেয়েটি তাকিয়ে আছে দুরে কোথাও ! কোথাও হারিয়ে গিয়ে ভাবছে কিছু একটা !
মুখে সেই বিষন্নতাটা লেগেই আছে !
আমি আবারও কিছুক্ষন তাকিয়েই রইলাম একভাবে ! দৃশ্যটা তে কি ছিল আমি ঠিক জানি না ! তবে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগছিল !
হঠাৎ কি হল বললাম
-তোমার মন ভাল ?
মেয়েটি যেন একটু চমকে উঠলো ! প্রথমে বুঝতেই পারলো না যে কথাটা কোথা আসছে !
আমি আবার বললাম
-এই যে উপরে তাকাও !
মেয়েটি আমার দিকে তাকালো ! বললাম
-মন খারাপ ?
-এই কথা কেন বলছো ?
-না তোমার চেহারা বলে দিচ্ছে ! মন খারাপ নাকি ?
-থাকতে পারে না ?
-পারে ! কেন পারবে না ? তবে মন খারাপ করে কি লাভ বল ? কোন লাভ নেই ! বিশেষ করে অন্যের জন্য নিজের দিন গুলো নষ্ট করার কোন মানে নেই !
-সব সমসয় কি নিজেকে নিয়ে থাকা যায় বল ?
এভাবেই আমাদের কথা শুরু ! আমরা টুকটাক কথা বলতে শুরু করি ! আমি উপরের বারান্দার মেয়েটি নিচের টাতে !
অবশ্য এখনও মেয়েটার নাম আমি জানতে চাই নি ! ফেসবুক আইডি দিয়েছিল সেখানে নাম ছিল "বিবর্ণ নীল" ! এই পর্যন্তই !
কথার ছলে অনেক কিছুই বলেছিল মেয়েটি ! আমি আগে যে মহিলাকে মেয়েটির মা মনে করতাম আসলে সে তার মা নয় ! আত্মীয় ! মা কোথায় জানতে চাইলে মেয়েটি বলে নি । কিংবা বলতে চায় নি ! আমিও শুনতে চাই নি !
মেয়েটির বাবা বাইরে থাকে । আর ফয়সাল সাহেব যে প্রায়ই আসে মেয়েটির চাচাতো ভাই ! খুব শীঘ্রই মেয়েটির সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা !
একদিন হঠাৎ মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম
-ফয়সাল কে তুমি ভালবাসো ?
-কেন ? হঠাৎ এই প্রশ্ন ?
-না এমনি ?
মেয়েটি কোন উত্তর দিল না !
আমি আবার বললাম
-ফয়সাল সাহেব তোমাকে ভালবাসে ?
-কি জানি ?
-তাহলে যে তোমাকে ভালবাসে না এমন একজন কে বিয়ে করবে কেন ?
আমার এই কথা টা শুনে মেয়েটি একটু মলিন হাসি হাসলো ! বলল
-দেখছো না আমি একটা খোঁড়া মেয়ে ! আমাদের অনেক চাহিদা/পছন্দ অপছন্দ থাকতে নেই !
আমি যেন কথা হারিয়ে ফেললাম ! কথা গুলোর মাঝে কি পরিমান অভিমান ছিল আমি ঠিকই বুঝতে পারছিলাম ।
একদিন রাতের বেলা, নিচের বাসা থেকে উচু গলায় আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ! জানালা দিয়ে উকি দিয়ে দেখি ফয়সাল সাহেবের সাথে মেয়েটি কথা কাটাকাটি হচ্ছে । আরও ভাল করে বললে হয় ফয়সাল সাহেব কথা বলছে আর মেয়েটি শুনছে ! মাঝে মাঝে কয়েকটি কথার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছে !
হঠাৎ হাত তোলার আওয়াজ পেলাম । একজনের গালে জোরে চড় মারলে যেমন আওয়াজ হয় সে রকম ! তাকিয়ে দেখি মেয়েটি উল্টে মেঝেতে পরে আছে হাতের ছতিটি একটু দুরে পরে আছে । ফয়সাল সাহেব রাগান্বিত চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে ! তার একটা কথাই কেবল কানে এল
-এখন থেকে আমার পছন্দ মত থাকতে হলে থাকবি নইলে চলে যাবি ! তোর মত মেয়ের অভাব হবে না !
তার কিছু না বলে ফয়সাল সাহেব চলে গেল ! আমি তাকিয়েই রইলাম মেয়েটির দিকে !
তারপর হঠাৎ করেই সব রকম যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল মেয়েটির সাথে ! কদিন বারান্দায় আসা বন্ধ ! সব গুলো জানালা থাকে বন্ধ ! ফেসবুকেও ইনএকটিভ !
কয়েকবার নক করেও কোন জবাব পেলাম না ! কয়েকদিন পরে দেখলাম তার আইডিটা ডিএকটিভেট করা । তবে আইডি বন্ধ করার আগে মেয়েটি আমাকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছে
------,
জীবন টা এরকমই । কিছুটা আমাদের ইচ্ছে মত হয় আর কিছুটা মেনে নিতে হয় । কষ্ট এখানেই যে আমাকে সব কিছুই মেনে নিতে হয়েছে । আমি বাবার কাছে চলে যাচ্ছি । সব কিছু পেছনে ফেলে রেখে । তুমি সেদিন বলেছিলেন না আমি তাকে ভালবাসি কি না ? না, তাকে আর ভালবাসি না । একটা সময়ে বাসতাম তবে এখন আর না । তুমি ভাল থেকো ! তোমার সাথে বলা কথা গুলো আমার মনে থাকবে !
কোন সম্মোধন নেই । কোন ইতি নেই ! চিঠি এখানেই শেষ !
আসলেই মেয়েটি ঠিকই বলেছে ! জীবন এরকমই ! কিছুটা আমাদের ইচ্ছে মত হয় আর কিছুটা আমাদের মেনে নিতে হয় !
YOU ARE READING
বুক পকেটের গল্পরা (ভলিউম ০৩)
Short Storyব্লগে গল্প লিখছি সেই ২০১১ সাল থেকে । অনেক গল্প সেখানে জমা হয়ে গেছে । সেই গল্প গুলোই আস্তে আস্তে এখানে এনে জমা করা হচ্ছে । দুইটা ভলিউম এর আগে প্রকাশ হয়েছে ।